-
চীন-যুক্তরাষ্ট্রের পাল্টাপাল্টি পদক্ষেপে বাণিজ্যযুদ্ধ নতুন মোড় নিয়েছে। একটি বাণিজ্য চুক্তির জন্য বিশ্বের শীর্ষ দুই অর্থনীতির মধ্যে আলোচনা চলমান থাকলেও দুই পক্ষের মধ্যে মতভেদ বেড়েই চলেছে। এদিকে একটি বাণিজ্য চুক্তিতে পৌঁছার জন্য চীনকে এক মাস সময় বেঁধে দিয়েছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প। এর প্রতিক্রিয়ায় চীন প্রথমবারের মতো স্পষ্ট করে জানাল, বাণিজ্যযুদ্ধ নিরসনে যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে তারা কী ধরনের পদক্ষেপ প্রত্যাশা করছে।
-
নতুন করে যুক্তরাষ্ট্রের ৬ হাজার কোটি ডলারের পণ্যে চীনের পাল্টা শুল্ক আরোপের ঘোষণায় বিশ্বের প্রধান শেয়ারবাজারগুলোয় ব্যাপক দরপতন লক্ষ করা গেছে। চীনা ঘোষণার প্রথম প্রভাব পড়ে ওয়াল স্ট্রিটে। এরপর গতকাল বিশ্বের অন্যান্য প্রধান শেয়ারবাজারে দরপতন দেখা দেয়। চীন পাল্টা শুল্ক আরোপ করলে বাণিজ্য সংঘাত আরো তীব্রতর হবে, যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের এই হুমকি অবজ্ঞা করে চার সহস্রাধিক মার্কিন পণ্যে ২৫ শতাংশ শুল্ক আরোপ করে বেইজিং। গত শুক্রবার কোনো চুক্তি ছাড়া আলোচনা শেষ হলে ২০ হাজার কোটি ডলারের চীনা পণ্যে শুল্ক বৃদ্ধির ঘোষণা দেয় যুক্তরাষ্ট্র। এদিকে বেইজিংয়ের পাল্টাপাল্টি শুল্ক আরোপের পরিপ্রেক্ষিতে চীনের আরো ৩০ হাজার কোটি ডলারের পণ্যে নতুন করে শুল্ক আরোপের প্রক্রিয়া শুরু করার নির্দেশ দিয়েছেন ট্রাম্প।
-
সম্প্রতি চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যকার পুনরায় বাণিজ্য উত্তেজনায় সৃষ্ট অনিশ্চয়তায় বড় করপোরেশনগুলোর চেয়েও বেশি ক্ষতির শঙ্কায় রয়েছে শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত স্বল্প মূলধনের ছোট মার্কিন কোম্পানিগুলো। বছরের বাকি অংশে তাদের জন্য আরো কঠিন হিসাব-নিকাশ দেখা দিতে পারে। ২০১৯ সালের দ্বিতীয়ার্ধে অল্প মূলধনের কোম্পানিগুলোর জন্য এসঅ্যান্ডপি-৫০০ সূচকে আয় বৃদ্ধির পূর্বাভাস দিয়েছিল ওয়াল স্ট্রিট। কিন্তু বিশ্বের শীর্ষ দুই অর্থনীতির মধ্যে বাণিজ্যযুদ্ধ তিক্ততর হওয়ায় সে আশায় গুড়ে বালি দেখা যাচ্ছে। বড় কোম্পানিগুলোর তুলনায় ছোট কোম্পানিগুলো বৈদেশিক বিক্রির ওপর কম নির্ভর করে বলে কিছু বিনিয়োগকারী অল্প মূলধনের কোম্পানিগুলোকে কম নাজুক মনে করছিল। কিন্তু চীনা আমদানিতে যুক্তরাষ্ট্রের বিশাল শুল্ক আরোপের ফলে যদি দেশটির অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ক্ষতিগ্রস্ত হয়, তাহলে ছোট কোম্পানিগুলোও মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। কারণ বড় বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর তুলনায় অনেক সময়ই ছোট কোম্পানিগুলোর আর্থিক নিরাপত্তা দুর্বল। যেহেতু অনেক মার্কিন কোম্পানি বিদেশী সরবরাহকারীদের ওপর নির্ভরশীল, শুল্ক বৃদ্ধিতে তাদের আমদানি পণ্যের দাম অনেক বেশি পড়বে।
-
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের ট্রেড ওয়ার বা বাণিজ্য যুদ্ধের জের ধরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এর প্রায় ২০০টি মার্কিন সংস্থা শীঘ্রই তাদের পণ্য উৎপাদনের মূ্*ল ঘাঁটি চিন থেকে ভারতে সরিয়ে নিতে চাইছে। মুলত কমিউনিস্ট শাসনে থাকা চিনের তুলনায় ভারত তাদের কাছে অনেক বেশি পছন্দের হয়ে উঠেছে। আপাতত ভারতে সাধারণ নির্বাচনের পর্ব চলছে। এটা শেষ হবার পর সরকার গঠনের প্রক্রিয়া শেষ হলেই সংস্থাগুলি এ বিষয়ে চুড়ান্ত পদক্ষেপ নিবে। এবিষয়ে ইউএসআইএসপিএফ-এর প্রেসিডেন্ট মুকেশ আঘি জানিয়েছেন যে শীর্ষস্থানীয় আমেরিকান গোষ্ঠী ইউএস-ইন্ডিয়া স্ট্র*্যাটেজিক অ্যান্ড পার্টনারশিপ ফোরাম (ইউএসআইএসপিএফ) এর সাথে কীভাবে ভারতে লগ্নি করা যায়, তা নিয়ে তাদের সঙ্গে সংস্থাগুলি আলাপ আলোচনা চালাচ্ছে।
-
ট্রাম্প বলছেন, চলতি মাসের শেষ দিকে ওসাকায় জি২০ সম্মেলনে তিনি চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের সঙ্গে বসতে যাচ্ছেন। তবে চীনের পক্ষ থেকে বরাবরই এ দাবি অস্বীকার করা হচ্ছে। চীনের সমঝোতাকারী দলের এ সদস্য বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্র মনে করছে, বাণিজ্যবিরোধ আরো কঠোর করার মাধ্যমে চীনকে চুক্তিতে পৌঁছতে বাধ্য করা যাবে, যা আসলে অসম্ভব কল্পনা। চীনের ওপর জোর করে কোনো বাণিজ্য চুক্তি চাপিয়ে দিতে পারে না যুক্তরাষ্ট্র।
উল্লেখ্য যে অর্থনৈতিক নীতিতে কাঠামোগত সংস্কারে নিয়ে আসার পূর্বপ্রতিশ্রুতি থেকে চীন সরে এসেছে—যুক্তরাষ্ট র গত মাসে এ অভিযোগ তুললে পরিস্থিতি তিক্ত আকার ধারণ করে। পরবর্তী সময়ে চীনের আরো ২০ হাজার কোটি ডলার মূল্যের পণ্য আমদানিতে সর্বোচ্চ ২৫ শতাংশ পর্যন্ত শুল্ক আরোপ করে। চীনও পাল্টা পদক্ষেপ হিসেবে ৬ হাজার কোটি ডলারের মার্কিন পণ্যে শুল্ক বৃদ্ধি করে।
-
চলমান চীন-মার্কিন বাণিজ্যযুদ্ধ ধাপে ধাপে অনেক দূর গড়িয়েছে। সর্বশেষ হুয়াওয়ে-কেন্দ্রিক ঘটনা ও প্রতিপক্ষের পণ্যের ওপর প্রতিশোধমূলক পাল্টাপাল্টি শুল্কারোপ ছিল এ বাণিজ্যযুদ্ধের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ দুটি পর্ব। চীন-মার্কিন বাণিজ্যযুদ্ধ এরই মধ্যে বিশ্ব অর্থনীতিকে প্রভাবিত করেছে, বিশ্বের শীর্ষ অর্থনীতির দুই দেশের চলমান বাণিজ্যযুদ্ধের কারণে ঝুঁকিতে পড়েছে দুর্লভ খনিজ পদার্থকেন্দ্রিক বিশ্ববাণিজ্য। চলমান বাণিজ্যযুদ্ধের কারণে ১৭ ধরনের দুর্লভ খনিজ পদার্থকেন্দ্রিক বিশ্ববাণিজ্যে কিছুটা অস্থিরতা দেখা দেবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা। এসব দুর্লভ খনিজ পদার্থ রোবটিকস, ড্রোন ও বৈদ্যুতিক গাড়ির মতো উচ্চপ্রযুক্তিনির ভর পণ্য তৈরিতে ব্যবহার করা হয়ে থাকে।
-
গতকাল ট্রাম্প ও চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের মধ্যে বহুল প্রত্যাশিত বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছে। বলতে গেলে গোটা বিশ্বের নজর ছিল এর দিকে। সবার প্রত্যাশা, এ বৈঠকের মাধ্যমে বিশ্বের দুই শীর্ষ অর্থনীতির মধ্যকার বাণিজ্য উত্তেজনা প্রশমিত হওয়া শুরু হবে। অর্থাৎ বাণিজ্যযুদ্ধের মাত্রা আর বাড়বে না। এ দ্বন্দ্বের কারণে উভয় দেশের কোম্পানিগুলো এরই মধ্যে কোটি কোটি ডলার লোকসানে পড়েছে, ম্যানুফ্যাকচারিং ও পণ্য সরবরাহ শৃঙ্খলে বড় ধরনের ব্যাঘাত ঘটছে। তাই এবার নতুন করে বাণিজ্য আলোচনা আবারও শুরু করতে সম্মত হয়েছে যুক্তরাষ্ট্র ও চীন এবং চীনা রফতানির ওপর নতুন করে শুল্ক আরোপ করবে না ওয়াশিংটন। চীনের সরকারি সংবাদ সংস্থা সিনহুয়া গতকাল এ তথ্য জানিয়েছে। এদিকে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প বলেছেন, আলোচনা নিয়ে তারা ‘ছন্দে ফিরতে শুরু করেছেন’। তবে কবে নাগাদ দুই দেশের মধ্যে ফের আলোচনা শুরু হতে পারে, সে বিষয়ে কিছু জানানো হয়নি।
-
মার্কিন-চীন বাণিজ্য বিরোধ এশিয়ার ম্যানুফ্যাকচারিং খাতে ক্রমে চাপ সৃষ্টি করে চলেছে। এ পরিস্থিতিতে চলতি বছরের জুনে এশিয়ার অধিকাংশ দেশের কারখানা কার্যক্রম সংকুচিত হতে দেখা গেছে। এছাড়া বিশ্বের শীর্ষ দুই অর্থনীতির দ্বৈরথের মধ্যে একটি বৈশ্বিক মন্দা পরিস্থিতি এড়াতে জোরালো পদক্ষেপ গ্রহণেরও চাপে রয়েছেন নীতিনির্ধারকরা। জাপানের ওসাকায় জি২০ নেতাদের সম্মেলনের পর ম্যানুফ্যাকচারিং খাতের জরিপ পাওয়া গেল। শনিবার জি২০ সম্মেলনের শেষ দিন বিশ্বনেতারা মন্থর বৈশ্বিক প্রবৃদ্ধি এবং ভূরাজনৈতিক ও বাণিজ্য উত্তেজনার তীব্রতা বৃদ্ধি নিয়ে সতর্ক করেছেন। এদিকে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প কোনো নতুন শুল্কারোপ না করা এবং চীনা প্রযুক্তি কোম্পানি হুয়াওয়ের নিষেধাজ্ঞা শিথিলসহ বেশকিছু ছাড়ের ঘোষণা দিয়েছেন। এর পরিপ্রেক্ষিতে জি২০ সম্মেলনে বাণিজ্য আলোচনা পুনরায় শুরু করতে সম্মতি জানিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র ও চীন। ট্রাম্পের এ ঘোষণা ও বাণিজ্য বিরোধ নিরসনে আলোচনা পুনরায় শুরুর সম্ভাবনা ব্যবসায়ী ও আর্থিক বাজারগুলোকে কিছুটা স্বস্তি এনে দিয়েছে।
তবে এ যুুদ্ধবিরতি দীর্ঘমেয়াদে উত্তেজনা প্রশমিত করলেও একই সঙ্গে দীর্ঘস্থায়ী অনিশ্চয়তা করপোরেট ব্যয়ের আগ্রহ ও বৈশ্বিক প্রবৃদ্ধিকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে বলে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন বিশ্লেষকরা।
-
গার্ডিয়ানএর খবর অনুসারে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের চীনের সঙ্গে বাণিজ্যযুদ্ধ এবং সুদহার বৃদ্ধি নিয়ে উদ্বেগের কারণে গত বছর শেয়ারবাজারগুলোয় ২ লাখ কোটি ডলার হারিয়েছেন বিশ্বের অতিধনীরা। দীর্ঘ সাত বছর ধারাবাহিক সম্পদ বৃদ্ধির পর ২০১৮ সালে বিশ্বের অতিধনী (সুপার রিচ) ব্যক্তিদের সমন্বিত সম্পদের মূল্য এক বছর আগের চেয়ে ৩ শতাংশ কমে ৬৮ দশমিক ১ ট্রিলিয়ন ডলারে দাঁড়িয়েছে। মূলত ক্রমবর্ধমান বাণিজ্য উত্তেজনার প্রভাবে আর্থিক বাজারগুলো পতনের জেরে এ পরিমাণ সম্পদ হারিয়েছেন অতিধনীরা। এ পতনে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে চীন। এছাড়াও মার্কিন-চীন বাণিজ্যযুদ্ধ ও যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় ব্যাংক ফেডারেল রিজার্ভের (ফেড) সুদহার বৃদ্ধির কারণে বৈশ্বিক অর্থনীতি নিয়ে ক্রমবর্ধমান অনিশ্চয়তায় গত বছর শেয়ারবাজারগুলোয় বড় পতন দেখা যায়। ফলে পেনশন তহবিল ও বিশ্বের অভিজাতদের বিনিয়োগ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
-
যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাণিজ্যযুদ্ধ চীনের অর্থনীতির ওপর নিশ্চিতভাবেই প্রভাব ফেলছে। তবে এটি ছাড়াও আরো বেশকিছু কারণ বিশ্বের দ্বিতীয় সর্ববৃহৎ অর্থনীতিটিকে স্থিতিশীল হতে দিচ্ছে না। আর এর জেরে প্রায় তিন দশকের মধ্যে চলতি বছর সবচেয়ে শ্লথগতির প্রবৃদ্ধি দেখতে যাচ্ছে দেশটি। পূর্বাভাস অনুযায়ী, চলতি বছরের দ্বিতীয় প্রান্তিকে চীনের জিডিপি প্রবৃদ্ধি হবে ৬ দশমিক ২ শতাংশ, যা তিন মাস সময়ে অনন্ত ১৯৯২ সালের পর সবচেয়ে শ্লথ। বছরের বাকি সময়ে বাহ্যিক চাহিদায় দুর্বলতা, কারখানাদরের সংকোচন এবং ম্যানুফ্যাকচারিং খাতের সংকোচন বিনিয়োগে স্থিতিশীলতা, ভোক্তা ব্যয় বৃদ্ধি ও আবাসন খাতের ঘুরে দাঁড়ানোর মধ্য দিয়ে সামাল দেয়া যাবে কিনা, তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে।