-
যুক্তরাষ্ট্র ও চীন বিশ্বের দুই শীর্ষ অর্থনীতি। দেশ দুটির মধ্যকার বাণিজ্য ও অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিশ্ব অর্থনীতির জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। কয়েক দশকে যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যকার দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক উন্নত হলেও বাণিজ্যনীতি নিয়ে সাম্প্রতিক বিরোধের কারণে এ সম্পর্কে ফাটল ধরেছে। বিশ্ব বাণিজ্যে বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্র চীনের সর্ববৃহৎ রফতানি বাজার ও ষষ্ঠ আমদানিকারক দেশ। অন্যদিকে চীন যুক্তরাষ্ট্রের দ্রুতবর্ধনশীল রফতানি বাজার ও সর্ববৃহৎ আমদানিকারক দেশ। বিবদমান দেশ দুটির মধ্যকার শুল্ক বিরোধ বৈশ্বিক বিনিয়োগকারীদের আত্মবিশ্বাসে নাড়া দিতে পারে, যা বিশ্ব অর্থনীতির জন্য ঝুঁকিপূর্ণ হতে পারে।
-
১লা মার্চ থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট এবং চীনের মধ্যে ৩ মাসের অস্থায়ী ট্যারিফ ডিলটি শেষ হবে। এখন দুই দেশের মধ্যে একটি চুড়ান্ত ডিল হতে পারে, অবশ্য এটা কোন নিদিষ্ট মাসের জন্য থাকবে না। আর এই ডিল যত দেরী হবে অন্য অর্থনীতিগুলো তত বেশি সুবিধা পাবে। এর মধ্যে জাপান ও জার্মান অন্যতম।
-
আগামী ১ মার্চের মধ্যে কোনো একটি চুক্তিতে পৌঁছার ক্ষেত্রে ট্রাম্পের বেঁধে দেয়া সময়সীমা শেষ হওয়ার আগে চূড়ান্ত দফা আলোচনা গত শুক্রবার শেষ হওয়ার কথা ছিল। স্পষ্টত উভয় পক্ষ আলোচনায় কোনো চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে পৌঁছতে না পারায় চীনের প্রতিনিধি দলের প্রধান উপপ্রধানমন্ত্রী লিয়ু হি যুক্তরাষ্ট্রের রাজধানীতে অবস্থানের সময় আরো দুদিন বাড়ানোর সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। শুক্রবার লিয়ু হি ও নিজ ক্যাবিনেটের মন্ত্রিদের পাশে দাঁড়িয়ে ট্রাম্প ইঙ্গিত দেন বিশ্বের শীর্ষ দুই অর্থনীতির মধ্যকার আলোচনায় যদি অগ্রগতি দেখা যায়, তাহলে ১ মার্চের সময়সীমা তিনি এক মাস বা তারও বেশি বাড়াতে প্রস্তুত রয়েছেন। চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধিরা সমঝোতায় পৌঁছতে সক্ষম হলে চূড়ান্ত পর্যায়ে শি জিনপিং ও ট্রাম্প দ্বিপক্ষীয় চুক্তিতে স্বাক্ষর করবেন বলে আশা করা হচ্ছে। ট্রাম্প আশা করছেন, চুক্তির বিষয়টি ‘অত দূরে নয়’ এবং তিনি মনে করেন চুক্তি না হওয়ার চেয়ে চুক্তি হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। এদিকে চীনের উপপ্রধানমন্ত্রী লিয়ু হি বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে শিগগিরই চুক্তি হচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রের অর্থমন্ত্রী স্টিভেন মানিউচিন ইঙ্গিত দেন, শীর্ষ পর্যায়ের নেতাদের মধ্যে ফ্লোরিডার মার-অ্যা-লাগো রিসোর্টে মার্চের শেষের দিকে আলোচনা অনুষ্ঠিত হতে পারে।
-
উভয় দেশের মধ্যকার এ বাণিজ্যযুদ্ধ দুই দেশের অর্থনীতিসহ বিশ্ব অর্থনীতিতে বেশ নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। আর গত শনিবার থেকে চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধিরা বাণিজ্য বিরোধ নিরসনে ৭ ঘণ্টারও বেশি সময় ধরে কারেন্সী রেট দরকষাকষি নিয়ে আলোচনা চালিয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও চীন।বেইজিং ইচ্ছেমতো ইউয়ানের মান অবমূল্যায়ন করবে না, ওয়াশিংটনের এ দাবি নিয়ে উভয় পক্ষের মধ্যে এখনো কোনো গুরুত্বপূর্ণ অগ্রগতি হয়নি। বিষয়-সংশ্লিষ্ট চারটি সূত্র জানিয়েছে, উভয় পক্ষ মুদ্রাচুক্তিসহ বাণিজ্য বিরোধ নিরসনে কোনো চুক্তিতে উপনীত হতে পারেনি।
উল্লেখ্য যে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট চীনের ২০ হাজার কোটি ডলারের পণ্যে শুল্ক ১০ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ২৫ শতাংশ করার হুমকি দিলেও শীর্ষ দুই অর্থনীতির মধ্যে বাণিজ্যযুদ্ধ আরো তিক্তকর অবস্থায় পৌঁছানোর বিষয়টি এড়াতে সময়সীমা মাসখানেক বাড়ানোরও ইঙ্গিত দিয়েছেন।
-
যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল, ১ মার্চের মধ্যে দুই দেশ কোনো চুক্তিতে না পৌঁছলে ২০০ বিলিয়ন ডলার মূল্যের চীনা পণ্যের ওপর শুল্কহার ১০ থেকে বাড়িয়ে ২৫ শতাংশ করবে ওয়াশিংটন। এখন এ সিদ্ধান্ত থেকে সরে এসেছেন ট্রাম্প, এছাড়াও ট্রাম্প শিগগিরই চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের সঙ্গে বৈঠকের মাধ্যমে একটি চুক্তি স্বাক্ষর করবেন। তাই যদি সবকিছু ঠিকমতো এগোয়, তাহলে আগামী এক বা দুই সপ্তাহের মধ্যে বড় কোন সংবাদ পাব। যদিও এই সংবাদের পর থেকেই এশিয়ার শেয়ারমার্কেটে লেনদেনের শুরুতেই সূচক বাড়তে দেখা যায়। সাংহাই কম্পোজিট সূচক বেড়েছে ২ দশমিক ৪০ শতাংশ এবং টোকিও নিক্কেই ২২৫ সূচক বেড়েছে শূন্য দশমিক ৭০ শতাংশ।
-
গত শুক্রবার এক টুইটে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প বিশ্বের শীর্ষ দুই অর্থনীতির মধ্যে আলোচনায় অগ্রগতির দাবি করে মার্কিন গরুর মাংস, শূকরের মাংসসহ কৃষিপণ্যে শুল্ক প্রত্যাহারের জন্য চীনের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। ফলে মার্চের ১ তারিখ থেকে চীনের পণ্যে শুল্ক ১০ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ২৫ শতাংশ করার হুমকি থেকে বিরত হলেন ট্রাম্প। গত বছর ট্রাম্পের শুল্ক আরোপের পরিপ্রেক্ষিতে মার্কিন কৃষিপণ্যে পাল্টাপাল্টি শুল্ক আরোপ করেছিল চীন। গত জুলাইয়ে সয়াবিন, গরুর মাংস, শূকরের মাংস ও মুরগির মাংসসহ প্রথম দফায় ৩ হাজার ৪০০ কোটি ডলারের মার্কিন পণ্য আমদানিতে ২৫ শতাংশ পাল্টাপাল্টি শুল্ক আরোপ হয়েছিল। যদিও ট্রাম্পের আহ্বান সম্পর্কে চীনের বাণিজ্য ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে ব্লুমবার্গ শনিবার ফ্যাক্স ও টেলিফোন করলে তারা কোনো উত্তর দেয়নি।
-
গত আট মাসের বাণিজ্যযুদ্ধে চীনের ২৫ হাজার কোটি ডলারের পণ্যে শাস্তিমূলক শুল্ক আরোপ করেছে যুক্তরাষ্ট্র। চীনও পাল্টাপাল্টি ১১ হাজার কোটি ডলারের মার্কিন পণ্যে শুল্ক আরোপ করে। এর ফলে বৈশ্বিক বাণিজ্যে অস্থিতিশীলতা দেখা দেয়, ম্যানুফ্যাকচারিং খাতের সাপ্লাই চেইন ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং যুক্তরাষ্ট্রের কৃষিপণ্য রফতানি সংকুচিত হয়। সম্প্রতি চীন ও যুক্তরাষ্ট্র ট্রেডওয়ার বন্ধ হবার জন্য একটি চুড়ান্ত চুক্তির কাছাকাছি চলে এসেছে। বিশ্বের শীর্ষ দুই অর্থনীতির মধ্যকার বাণিজ্য আলোচনায় অগ্রগতির পরিপ্রেক্ষিতে অর্থনীতিতে কাঠামোগত পরিবর্তন আনতে চীন সম্মত হলে বেইজিংয়ের ২০ হাজার কোটি ডলারের পণ্যে অতিরিক্ত শুল্ক আরোপ থেকে বিরত থাকতে সম্মত হয়েছে ওয়াশিংটন। যা আগামী ২৭ মার্চের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ও চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং একটি চূড়ান্ত চুক্তিতে স্বাক্ষর করতে পারেন।
-
যুক্তরাষ্ট্রের কয়েকটি শীর্ষ বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতিবিদদের দ্বারা গঠিত একটি দলের গবেষণ ‘ দ্য রিটার্ন টু প্রটেকশনিজম’ এ দেখা যায় নের মতো দেশগুলোর সঙ্গে প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের বাণিজ্যযুদ্ধে আদতে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে মার্কিন অর্থনীতিই। কেননা মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের বাণিজ্যযুদ্ধের কারণে ২০১৮ সালে জিডিপিতে ৭৮০ কোটি ডলার হারিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতি। যদিও ট্রাম্প প্রশাসনের দাবি, এ যুদ্ধ যুক্তরাষ্ট্রের কর্মসংস্থান, প্রযুক্তি ও মেধাসম্পত্তি রক্ষা করছে। মুলত ট্রাম্পের ‘লক্ষ্যবস্তু করা’ দেশগুলো থেকে আমদানি কমেছে ৩১ দশমিক ৫ শতাংশ, যখন ‘লক্ষ্যবস্তু হওয়া’ যুক্তরাষ্ট্রের রফতানি কমেছে ১১ শতাংশ। এছাড়াও আমদানির উচ্চতর ব্যয়ের কারণে বার্ষিক ভোক্তা ও উৎপাদকদের বার্ষিক মোট ক্ষতি হয়েছে ৬ কোটি ৮৮ লাখ ডলার।
-
মার্কিন-চীন বাণিজ্য চুক্তি হলেও বিশ্বের শীর্ষ এ দুই অর্থনীতির মধ্যকার দ্বন্দ্বের যে ইতি ঘটবে, সে সম্ভাবনা ক্ষীণ। গত বছর থেকে এ দুই দেশ বাণিজ্যযুদ্ধে লিপ্ত, যার নেতিবাচক প্রভাব বিশ্ব অর্থনীতিতে পড়ছে। তবে অনেক বিশ্লেষক বলছেন, এ দুই অর্থনীতির মধ্যে দ্বন্দ্ব শুধু বাণিজ্য নিয়ে নয়, তার চেয়েও বেশি কিছু। বাণিজ্যযুদ্ধ এ দুই দেশের ক্ষমতার দ্বন্দ্বকে প্রতিফলিত করছে। চুক্তি হোক আর না-ই হোক, আশঙ্কা করা হচ্ছে দুই দেশের দ্বন্দ্বের তীব্রতা আরো বাড়বে এবং সমস্যার সমাধান কঠিনতর হয়ে উঠবে। পরামর্শক প্রতিষ্ঠান ইউরেশিয়া গ্রুপের এশিয়া অঞ্চলের পরিচালক মাইকেল হারসন বলেন, আমরা একটি নতুন স্বাভাবিক পরিস্থিতিতে প্রবেশ করেছি; যেখানে মার্কিন-চীন ভূরাজনৈতিক প্রতিযোগিতা তীব্রতর হচ্ছে এবং আরো বেশি করে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। তিনি বলেন, মার্কিন-চীন ক্ষমতার দ্বন্দ্বকে কিছুটা হ্রাস করতে পারে একটি বাণিজ্য চুক্তি, তবে এর প্রভাব হবে সাময়িক ও সীমিত।
বিশ্লেষকরা বলছেন, মার্কিন-চীন দ্বন্দ্ব প্রযুক্তি খাতে গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলতে পারে, কেননা বিশ্বের প্রযুক্তি নেতা হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে উভয় দেশই চেষ্টা করছে। সাম্প্রতিক মাসগুলোতে বিশ্বের সর্ববৃহৎ এ দুই অর্থনীতির মধ্যে যে বাণিজ্য আলোচনা হয়েছে, সেখানে প্রধান ইস্যুগুলো ছিল মূলত প্রযুক্তিসংশ্লিষ ট।
-
যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যে দীর্ঘদিনের বাণিজ্য বিরোধ নিষ্পত্তির লক্ষ্যে আয়োজিত *দুই দিনব্যাপী বাণিজ্য আলোচনা কোনো ধরনের চুক্তি ছাড়াই গত শুক্রবার শেষ হয়েছে। যদিও ওয়াশিংটনে এ আলোচনার মাধ্যমে বিশ্বের দুই বৃহৎ অর্থনীতির মধ্যে একটি চুক্তি স্বাক্ষরের মাধ্যমে অর্থনীতিতে উত্তেজনা হ্রাসের ছিলো। কিন্তু এই বাণিজ্য আলোচনা চলাকালেই চীন থেকে আমদানিকৃত ২০ হাজার কোটি ডলারের পণ্যের ওপর ১০ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ২৫ শতাংশ শুল্ক আরোপের ঘোষণা দেয় যুক্তরাষ্ট্র। এ ঘটনায় উদ্বেগ জানিয়ে বেইজিং বলেছে, তারাও পাল্টা ব্যবস্থা নেবে। এতে করে বিশ্ব অর্থনীতি বড় ধরনের একটি ধাক্কা খেতে যাচ্ছে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।