রাজনীতিতে দুই প্রধান দল বা জোটের আধিপত্যের কারণে রাজনীতির সমার্থক হয়ে দাঁড়িয়েছে পরিবারতন্ত্র, ব্যক্তির কর্তৃত্ব, দলে গণতন্ত্রহীনতা, শাসনে স্বৈরতন্ত্র, স্বেচ্ছাচারিতা, সন্ত্রাস, সহিংসতা, মিথ্যাচার আর কুৎসা। এ রকম একটি ধারণা আছে যে বাংলাদেশের অর্থনীতির অবস্থা ভালো, কিন্তু রাজনীতি পিছিয়ে, যা ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণায়ও উঠে এসেছে।
কিন্তু রাজনীতিতে এসবের প্রাধান্য থেকে বর্তমান অর্থনীতির দৃশ্যমান জৌলুশ কি আলাদা করা যায়? এটা ঠিক যে বাংলাদেশে গত দুই দশকে জিডিপির প্রবৃদ্ধির হার বিশ্বের গড় হার থেকে বেশি। আর্থিক তৎপরতায় মানুষের যুক্ততা ও গ্রাম-শহরের যোগাযোগ বেড়েছে। আয়–উপার্জনে যুক্ত মানুষের অনুপাত আগের যেকোনো সময়ের তুলনায় বেশি। কিন্তু শুধু জিডিপির পরিসংখ্যান দিয়ে প্রবৃদ্ধির গুণগত দিক বোঝা যায় না।
গত কয়েক দশকে বাংলাদেশে আমরা পেয়েছি অনেক ভবন, যোগাযোগ প্রযুক্তির প্রসার ঘটেছে অভূতপূর্ব হারে। নদী, পাহাড়, বন, উন্মুক্ত স্থানবিনাশী উন্নয়নে আমরা আরও পেয়েছি: ১. বিপুল চোরাই টাকার মালিক একটি ক্ষুদ্র গোষ্ঠী; ২. একটি ক্ষুদ্র সচ্ছল মধ্যবিত্ত গোষ্ঠী; ৩. অনিশ্চিত জীবন ও জীবিকায় ক্লান্ত নিম্ন মধ্যবিত্ত গোষ্ঠী; ৪. প্রাক্তন শিল্প শ্রমিক ও বর্তমান কর্মসন্ধানীদের বিপুল সমাবেশ; ৫. শিক্ষা ও চিকিৎসাসহ বিভিন্ন গণদ্রব্যের বাজারীকরণ; ৬. ভোগবাদিতা আর অমানবিকতার অশ্লীল সমাবেশ; ৭. শিক্ষা ও চিকিৎসার বাণিজ্যিকীকরণের কারণে এর সুযোগ থেকে বঞ্চিত বিশাল জনসংখ্যা; ৮. রাষ্ট্রীয় সম্পত্তি ও সাধারণ সম্পত্তির ব্যক্তিগত সম্পত্তিতে রূপান্তর; ৯. নদী-নালা, খাল-বিল, বন-পাহাড়ে দখলদারির বিস্তার; বাণিজ্য বা মুনাফালোভী তৎপরতার দাপটে বিপর্যস্ত আবাদি জমি, জলাশয়, উন্মুক্ত স্থান এমনকি সুন্দরবন; ১০. রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান খণ্ড খণ্ড করে জনগণের নিরাপত্তাব্যবস্থ র ভাঙন; ১১. তেল, গ্যাসসহ জনগণের প্রাকৃতিক সম্পদ বহুজাতিক কোম্পানির হাতে জিম্মি; ১২. উৎপাদনশীল ভিত্তি দুর্বল করে দোকানদারি অর্থনীতির প্রসার এবং ১৩. সর্বজনের স্বার্থকে প্রান্তিকীকরণ করে কতিপয় গোষ্ঠীর স্বার্থরক্ষায় অর্থনৈতিক নীতিনির্ধারণ।
অর্থনৈতিক তৎপরতায় ব্যাংক লুট (ঋণখেলাপি, জালিয়াতি) করে হাজার হাজার কোটি টাকা আত্মসাৎ, শেয়ারবাজারে প্রতারণা ও প্রভাব বিস্তার, জমি-পাহাড়-নদী-জলাশয় দখল, রাষ্ট্রীয় বৃহৎ প্রকল্পে শতকরা ২০০ বা ৩০০ ভাগ বেশি ব্যয়, বিদেশি ঋণে ভোগবিলাসিতা, কমিশনের বিনিময়ে দেশের জন্য সর্বনাশা চুক্তি স্বাক্ষর—এগুলো সবই বর্তমান অর্থনীতির অবিচ্ছেদ্য অংশ। যাঁরা শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারির সঙ্গে জড়িত, যাঁরা ঋণ নিয়ে বড় বড় খেলাপি, তাঁরাই তো দেশের অর্থনীতির প্রভাবশালী নীতিনির্ধারক, রাজনীতিবিদ।