আমি ইউরোপ নিয়ে সত্যিকার অর্থেই চিন্তিত । আরো সত্য হলো আমি গোটা পৃথিবীটা নিয়েই চিন্তিত । চলমান অর্থনৈতিক মন্দা থেকে গোটা পৃথিবীতে কেউই নিরাপদ স্বর্গে বাস কর*ছে না । তা সত্ত্বেও আমি মার্কিন যুক্তরাস্ট্র অপেক্ষা ইউরোপ নিয়ে বেশি চিন্তিত ।

এটা প্রথমেই পরিস্কার করে নেয়া ভালো যে আমি এখানে গড়পড়তা আমেরিকানদের মতো ইউরোপের উচ্চ করের হার বা সরকার নিয়ন্ত্রিত সামাজিক সেবাখাত নিয়ে অভিযোগ কর*ছি না । বড় ওয়েলফেয়ার স্টেটগুলো ইউরোপের চলমান অর্থনৈতিক সংকটের জন্য দায়ি নয় । প্রকৃতপক্ষে আমি ওখানে সরকার নিয়ন্ত্রিত ওয়েলফেয়ার সিস্টেম যে এই সংকটা কাটাতে ভূমিকা রাখছে সেটাই বলার চেষ্টা করবো ।

ইউরোপের চলমান সংকট রাজস্ব ও মুদ্রানীতির বিভিন্ন দিকেই অত্যন্ত মারাত্মক আকার ধারন করেছে । গুরুত্ব বিচারে এটা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে তুলনা করা যেতে পারে । তবে ইউরোপিয় ইউনিয়ন এই সংকট মোকাবেলায় গৃহীত পদক্ষেপে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে খুব বেশী রকমের পিছিয়ে আছে ।

প্রথমত রাজস্ব নীতির কথা বলা যায় । এখানে অনেক অর্থনীতিবিদের মতো আমি নিজেও মনে করি পরিস্থিতির গুরুত্ব অনুযায়ী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ওবামা সরকারের গৃহীত স্টিমুলাস প্যাকেজ যথেষ্ট নয় । তবে এই স্টিমুলাস প্যাকেজ প্রশ্নটিতে ইউরোপের তুলনায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র খুব দ্রুতই সিদ্ধান্তে আসতে পেরেছে ।

দ্বিতীয়ত, মুদ্রা নীতিতেও সেই একই পিছিয়ে পড়ার গল্প রয়েছে । মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় ব্যাংক ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক থেকে ইউরোপিয় ইউনিয়নের কেন্দ্রীয় ব্যাংক স্পষ্টতই পিছিয়ে আছে । ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক সুদের হার কমাতে খুব দ্রুতই এগিয়ে এসেছে । অন্যদিকে ইউরোপিয়ান কেন্দ্রীয় ব্যাংক এটা করতে অনেক গড়িমসি করেছে । এমনকি গত বছরের জুলাইতে তারা এই হার বাড়িয়েছে পর্যন্ত !

তবে এই চলমান সংকটে ইউরোপিয় ইউনিয়ন তাদের যে বিষয়টি নিয়ে এগিয়ে থাকবে সেটা হলো তাদের সদস্য দেশগুলোতে সরকার নিয়ন্ত্রিত সামাজিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা । এই সামাজিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা ব্যক্তিপর্যায়ে অর্থনৈতিক সংকটের প্রভাব সীমিত রাখতে সাহায্য করবে । এই সামাজিক নিরাপত্তা খুব ছোট ব্যাপার নয় । সবার জন্য নিশ্চিত স্বাস্থ্য বীমা ব্যবস্থা, চাকরি হারানো সবার জন্য বেকার ভাতা নিশ্চিতভাবেই অর্থনৈতিক মন্দার প্রভাব ব্যক্তিগত পর্যায়ে কমিয়ে আনবে । এবং এই সরকারি সুবিধাগুলো ভোক্তাদের বাজারে অর্থব্যয়ের সুযোগ তৈরী করে দেয় যেটা শেষ বিচারে অর্থনীতিতে সুফল বয়ে আনে ।

তবে এইসব স্বয়ংক্রিয় ব্যবস্থা থেকে এই মুহুর্তে যেটা দরকার সেটা হলো সরকারের এগিয়ে আসা । এবং ইউরোপ এদিক দিয়ে পিছিয়ে আছে ।

প্রশ্ন উঠতে পারে ইউরোপ এভাবে পিছিয়ে পড়লো কেন । অদক্ষ নেতৃত্ব এটার একটা কারন হিসেবে আমরা ধরতে পারি । ইউরোপের ব্যাংকিং সেক্টরের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা চলমান অবস্থার গুরুত্ব বুঝতে পুরোটাই ব্যর্থতা দেখিয়ে চলেছেন । নিজেদের সাফল্যের কীর্তি প্রচারেই তাদের আগ্রহ বেশী । জার্মান অর্থমন্ত্রীর জুড়ি মেলা, যিনি এসব বিষয়ে কিছুই জানেন না ও যার কথা শোনা সময় নষ্ট, এই আমেরিকাতে রিপাবলিকানদের মধ্যেই সম্ভব ।

তবে এর থেকেও বড় সমস্যা রয়ে গেছে । ইউরোপের অর্থনৈতিক একত্রিকরণ তাদের রাজনৈতিক নেতৃত্বের একত্রিকরণ থেকে বহুদুর পিছিয়ে আছে । প্রায় গোটা ইউরোপের অর্থব্যবস্থা একই মুদ্রায় চলে এবং তাদের মধ্য অর্থনৈতিক সম্পর্ক সহজেই আমেরিকার এক প্রদেশ থেকে আরেক প্রদেশের সম্পর্কের সাথে তুলনা করা যায় । তা সত্ত্বেও ইউরোপের নেতারা এই অর্থনৈতিক সুসম্পর্ককে রাজনৈতিক পর্যায়ে প্রতিষ্ঠিত করতে ব্যর্থ হয়েছেন । এই ঐক্যের অভাব বড় বেশী টের পাওয়া যাচ্ছে এই মন্দাসময়ে ।

এই সমস্যাটাই সংকট মোকাবেলায় রাজস্ব নীতির অচলাবস্থার জন্য দায়ি করা যেতে পারে । কোন সরকারই ইউরোপের সম্মিলিত স্টিমুলাস প্যাকেজে বেশী টাকা ঢালতে রাজি নন । কারন ঐ টাকা তাদের নিজের দেশের নাগরিকদের কোন কাজে নাও লাগতে পারে ।

অন্যদিকে মুদ্রানীতিতে এতোটা জটিলতা না থাকলেও সেখানেও যথেষ্ট কর্মতৎপরতার অভাব দেখা যায় । ইউরোপিয়ান কেন্দ্রীয় ব্যাংক ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংকের মতো সহজেই স্বাধীনভাবে একটি লক্ষ্য নিয়ে কাজ করতে পারেনা । সেখানে নীতিনির্ধারক পর্যায়ে সারাক্ষনই ১৬টি দেশের প্রতিনিধিদের বাদানুবাদ লেগে থাকে যার ফলশ্রুতিতে অনিবার্যভাবেই কালক্ষেপন দেখা দেয় ।

ইউরোপ এসব কারনে এরকম সংকটকালে সাংগঠনিকভাবে দুর্বল সংগঠন হিসেবে দেখা দিচ্ছে ।