রপ্তানি পণ্যের বাজারে চীনাদের দাপট বহু দিন ধরেই। কম খরচে পণ্য বানিয়ে তারা যেমন উন্নত দেশগুলোর বাজার ধরছে, তেমনি বাংলাদেশের মতো নিম্ন মধ্যআয়ের দেশেও চীনা পণ্যের জয়জয়কার। তবে গত কয়েক মাস ধরে তাদের রপ্তানি আয়

পড়তির দিকে। জুলাইতে রপ্তানি আয় ৮ শতাংশ কমার পর চীনা সরকার তাদের মুদ্রা ইউয়ানের মান কমিয়ে দেয়। ফলে এক ডলার রপ্তানির বিপরীতে রপ্তানিকারকরা যে পরিমাণ স্থানীয় মুদ্রা পেত, তার চেয়ে বেশি পাওয়া শুরু করে।

এই বাড়তি প্রণোদনা রপ্তানি খাতকে কিছুটা হলেও ঘুরে দাঁড়াতে সহায়তা করেছে। আগস্ট মাসে রপ্তানি আয় কমার হার ৫.৫ শতাংশে দাঁড়িয়েছে, যা ৬ শতাংশ কমবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছিল। অন্যদিকে ডলারের বিপরীতে ইউয়ানের মান কমে যাওয়ায় আমদানি আরো কঠিন হয়েছে। আগস্টে চীনের আমদানি কমেছে ১৪ শতাংশ। এভাবে মুদ্রার দাম কমিয়ে দেওয়াকে বলা হচ্ছে 'মুদ্রাযুদ্ধ'। এ যুদ্ধে চীনারাই এগিয়ে। যুক্তরাষ্ট্রের হুমকি, তিরস্কার এড়িয়ে চীনা সরকার প্রয়োজন হলে মুদ্রার মান কমাতে দ্বিধা করছে না। শুধু চীনের ইউয়ান নয়, নানা কারণে ডলারের বিপরীতে দাম হারিয়েছে ইউরোপীয় ইউনিয়নের অভিন্ন মুদ্রা ইউরো, রাশিয়ার রুবল, ভারত ও পাকিস্তানের রুপি, ভিয়েতনামের ডংসহ অনেক দেশের মুদ্রা। ফলে ওইসব দেশ রপ্তানির ক্ষেত্রে সক্ষমতার দিক দিয়ে এগিয়ে গেছে।

কিন্তু বাংলাদেশ এ ক্ষেত্রে উল্টোপথে হাঁটছে। ২০১১ সালের শেষদিকে ডলারের দাম ৮৪-৮৫ টাকা পর্যন্ত উঠেছিল। এখন সেটা ৭৮ টাকায় নেমেছে। দাম ধরে রাখতে দফায় দফায় বাজার থেকে ডলার কিনেও খুব বেশি সুবিধা করতে পারছে না বাংলাদেশ ব্যাংক। ২৪ বিলিয়ন ডলারের রিজার্ভের কারণে ডলার এখন খুবই সহজলভ্য। এদিকে রপ্তানিকারকরা সক্ষমতা ধরে রাখতে ডলারের দাম কমানো অথবা রপ্তানি খাতের জন্য আলাদা বিনিয়ম হার চালুরও দাবি করেছে। নইলে তারা রপ্তানির বিপরীতে নগদ সহায়তা বাড়ানোর দাবি একাধিকবার তুলে ধরেছে সরকারের কাছে। এ নিয়ে গতকাল অর্থ মন্ত্রণালয়ে একটি আন্তমন্ত্রণালয় বৈঠকও হয়েছে। বৈঠকে নগদ সহায়তা বাড়ানোর বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি বলে জানিয়ে অর্থ মন্ত্রণালয়ের জ্যেষ্ঠ সচিব মাহবুব আহমেদ বলেন, 'টাকার মান বাড়ায় রপ্তানিকারকরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। তাদের নগদ সহায়তা বাড়ানোর দাবির বিষয়ে আমরা পর্যালোচনা করেছি। আরো কিছুদিন পর্যালোচনা করা হবে। এখনো কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি।'

২০১০ সালে 'কারেন্সি ওয়ার' বা মুদ্রাযুদ্ধ শব্দগুচ্ছটি প্রথম ব্যবহার করেন ব্রাজিলের অর্থমন্ত্রী গুইডো মানতেগা। পরে বিভিন্ন দেশের নীতিনির্ধারক ও সংবাদকর্মীরা নামটি ব্যবহার শুরু করেন ব্যাপকভাবে। ২০০৯ সাল থেকে চীনের সঙ্গে মুদ্রাযুদ্ধে জড়িয়ে আছে যুক্তরাষ্ট্র। যুক্তরাষ্ট্রের নেতারা চীনা সরকারকে বারবার তাঁদের মুদ্রার মান বাড়ানোর তাগিদ দিয়েছেন। তাঁদের দাবি, চীন ইচ্ছে করে ইউয়ানের দাম কমিয়ে রেখেছে। খুব বেশি চাপে পড়লে চীন মাঝে মাঝে মুদ্রার মান বাড়ায়। তবে গত আগস্ট মাসে দুই দফায় তারা মুদ্রার দাম প্রায় ৪ শতাংশ কমিয়ে ফেলে। চীন বছরে প্রায় দুই হাজার ২০০ বিলিয়ন ডলারের পণ্য রপ্তানি করে। আমদানি করে এর চেয়ে অনেক কম। ফলে মুদ্রার মান বাড়ালে তাদের রপ্তানিকারকদের সুবিধা হয়। আমদানি আরো কঠিন হয়। চীনের মতো সরকারি হস্তক্ষেপে না হলেও নানাভাবে কমেছে রাশিয়ার রুবল, ভারতের রুপি, ভিয়েতনামের ডং ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের অভিন্ন মুদ্রা ইউরোর দাম।

২০১৪ সালের ৭ অক্টোবর থেকে গত ১ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ডলারের বিপরীতে বিভিন্ন মুদ্রার দরপতনের একটি হিসাব তৈরি করেছে পোশাক রপ্তানিকারকদের সংগঠন বিজিএমইএ। তাদের হিসাবে ওই সময়ে ইউরো ১১.৮৭ শতাংশ, রুবল ৬৫.২৫ শতাংশ, রুপি ৭.৬৮ শতাংশ ও ডং ৫.৪৫ শতাংশ দর হারিয়েছে। অন্যদিকে চীন তাদের মুদ্রার দর কমিয়েছে ৩.৫৮ শতাংশ।

বাংলাদেশ রপ্তানিকারক সমিতির (ইএবি) সভাপতি আবদুস সালাম মুর্শেদী কালের কণ্ঠকে বলেন, ডলারের বিপরীতে টাকার মান বেড়েছে। কিন্তু একই সময়ে প্রতিযোগী দেশগুলোর মুদ্রার মান কমেছে। এতে স্বয়ংক্রিয়ভাবে প্রতিযোগীদের রপ্তানির সক্ষমতা বেড়ে যাবে। তাদের কোনো কষ্ট করতে হবে না। এ কারণেই ইন্দোনেশিয়া, ভিয়েতনাম, কম্বোডিয়া, পাকিস্তান, ভারতসহ অনেক দেশ রপ্তানিতে ভালো করছে। ভারত ও চীনের মুদ্রার অবমূল্যায়ন সম্পর্কে সালাম মুর্শেদী বলেন, তারা বস্ত্র খাতে খুবই শক্তিশালী। তাদের কাঁচামাল আছে। বাংলাদেশের তা নেই। ফলে মুদ্রার মানের দিক দিয়েও এগিয়ে গেলে তাদের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় টেকা কঠিন।

সালাম মুর্শেদী জানান, এখন বেশির ভাগ ক্রেতা প্রতিষ্ঠান পোশাকের কাঁচামাল কেনার জন্য কম্পানির নাম ও দাম নির্ধারণ করে দেয়। ফলে চীন ও ভারতে মুদ্রার দাম কমলেও সেই সুফল দেশের পোশাক রপ্তানিকারকরা নিতে পারে না।

২০১৪-১৫ অর্থবছরে বাংলাদেশ রপ্তানি করে আয় করেছে প্রায় ৩১ বিলিয়ন বা তিন হাজার ১২০ কোটি ডলার। যা লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ৬ শতাংশ কম। যদিও আগের বছরের চেয়ে তা ৩.৩৫ শতাংশ বেশি বলে দেখা গেছে ইপিবির পরিসংখ্যানে। তবে প্রবৃদ্ধির এ হার ১৩ বছরের মধ্যে সবচেয়ে কম।

অর্থনীতি বিশ্লেষক মামুন রশীদ কালের কণ্ঠকে বলেন, ভারত, শ্রীলঙ্কা, পাকিস্তান, ইন্দোনেশিয়া, ভিয়েতনামসহ প্রতিযোগীরা তাদের মুদ্রার মান কমানোয় সে দেশ থেকে কেনা ইউরোপ ও আমেরিকার ক্রেতাদের জন্য কিছুটা লাভজনক। কারণ খরচ কম পড়বে। বিপরীতে বাংলাদেশ থেকে কিনলে মুদ্রার মানের দিক দিয়ে খরচ বেশি পড়বে। টাকার মান কমানো সম্ভব কি না জানতে চাইলে তিনি আরো বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংক এখন এটি বিশ্লেষণ করতে পারে। যেখানে দেখা উচিত টাকার মান কমালে কী কী প্রভাব পড়বে। এরপর মুদ্রার 'রেফারেন্স রেট' তারা একটু বাড়িয়ে দিতে পারে। তিনি বলেন, 'বাজার এখন টাকার মান কমাতে প্রস্তুত। কেউ ডলার কিনতে গেলে ৮১ টাকার নিচে পাবে না। এখন রেফারেন্স রেট বাড়িয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক যদি বাজারের দিকে ইঙ্গিত দেয় তাহলে টাকার মান কমবে।'