দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ছিল মূলত শুল্কের যুদ্ধ। আর তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগেই শুরু হয়েছে মুদ্রাযুদ্ধ। প্রথম মহাযুদ্ধের পর গত শতাব্দীর ত্রিশের দশকে গোটা বিশ্ব ব্যাপক অর্থমন্দার মুখে পড়ে। কমে যেতে থাকে মানুষের ক্রয়ক্ষমতা। তখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, ইউরোপসহ ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের সকল দেশই তাদের আমদানি শুল্ক বহুগুণ বাড়িয়ে দেয়। যাতে বৈদেশিক মুদ্রার ব্যবহার আর আমদানি কমে গিয়ে বেড়ে যায় নিজ দেশের রফতানি আয়। বাড়ে বাণিজ্য ভারসাম্য। কিন্তু এতে ক্ষতিগ্রস্ত হতে থাকে ওই সময়ের প্রধান রফতানিকারক দেশ জার্মানী। বাজার হারিয়ে শিল্পোন্নত দেশ জার্মানীর বড় বড় কোম্পানিগুলো একের পর এক বন্ধ হতে থাকে। স্থবির হয়ে পড়ে জার্মানীর অর্থনীতি। পরিস্থিতি মোকাবেলায় জার্মানীর শাসক হিটলার তার পণ্যের আমদানিকারক দেশগুলোকে শুল্ক কমানোর অনুরোধ জানিয়ে যখন ব্যর্থ হন, তখন বিদেশী বাজারগুলো পুনরুদ্ধারে যুদ্ধের সিদ্ধান্ত নেন। তবে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হবার পর পুঁজিবাদী পশ্চিমা উন্নত দেশগুলো যে যার ইচ্ছেমতো আর আমদানি শুল্ক বাড়াতে পারবে না বলে সিদ্ধান্ত নেয়। এক্ষেত্রে তারা জনস্বার্থে পণ্যের মূল্য কমিয়ে বাজার সম্প্রসারণে সবার আমদানি শুল্কে একটি ভারসাম্য ও শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠার নীতি গ্রহণ করে এবং ৪৫ বছর ধরে বহু দেন-দরবারের পর অবশেষে জাতিসংঘের ছত্রচ্ছায়ায় প্রতিষ্ঠা করে ওয়ার্ল্ড ট্রেড অর্গানাইজেশন (ডব্লিউটিও) বা বিশ্ববাণিজ্য সংস্থা। যার মূল কাজ- ক্রমান্বয়ে আমদানি শুল্ক রহিত করে বিশ্বকে একটি শুল্কবিহীন মুক্ত বাণিজ্যের দিকে নিয়ে যাওয়া। সুতরাং আমদানি শুল্ক বাড়িয়ে অর্থমন্দা মোকাবেলা ও নিজের বাজার রক্ষা করার কৌশল গ্রহণের দিন এখন শেষ। তাহলে মন্দা মোকাবেলার উপায় কি?

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হবার প্রায় ষাট বছর পর উন্নত দেশগুলো আবারও অর্থমন্দার কবলে পড়েছে। আর এই মন্দা মোকাবেলায় তারা শুরু করেছে এক নতুন যুদ্ধ। যার নাম মুদ্রা যুদ্ধ। বিশ্বের প্রধান প্রধান অর্থনীতির প্রায় সকল দেশই গত কয়েক বছর যাবৎ তাদের নিজ নিজ মুদ্রার ক্রমাগত অবমূল্যায়ন করে চলেছে। এমনকি আন্তর্জাতিক মুদ্রা- ডলারের দেশ, খোদ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রও গত এক দশকে তার মুদ্রার প্রায় ২৫ শতাংশ অবমূল্যায়ন করেছে। উদ্দেশ্য- আমদানিকে ব্যয়বহুল করে বিদেশী পণ্য আমদানি কমানো এবং নিজ দেশের পণ্য উৎপাদন ও রফতানি বাড়ানো। এই কৌশল মোকাবেলায় অন্যান্য প্রতিদ্বন্দ্বী দেশগুলোও তাদের মুদ্রার মান কমিয়ে দিচ্ছে। এতে মূল্যস্ফীতি কিছুটা বাড়লেও নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে বিদেশী পণ্যের আমদানি এবং বাড়ছে নিজ দেশের পণ্য উৎপাদন, রফতানি ও রেমিট্যান্স আয়। বাণিজ্য ভারসাম্য থাকছে নিজেদের অনুকূলে। কিন্ত কেউই সরকারিভাবে এই কৌশল গ্রহণের কথা স্বীকার করছে না। তারা এর দায় চাপাচ্ছে বাজারের ওপর।