২০০৩ সালে আইএমএফের পরামর্শে বাংলাদেশে ভাসমান মুদ্রা বিনিময় ব্যবস্থা চালু হয়। অর্থাৎ বৈদেশিক মুদ্রা বিনিময় হারকে বাজারের উপর ছেড়ে দেয়া হয়। এর আগ পর্যন্ত কেন্দ্রীয় ব্যাংকই ডলার-টাকার বিনিময় হার ‘ঠিক’ করে দিত। সে হার ধরেই লেনদেন হতো। তবে এটা আসলে লোক দেখানো। এখনো মূলত বৈদেশিক মুদ্রার বাজার নেপথ্যে নিয়ন্ত্রণ করছে কেন্দ্রীয় ব্যাংকই। ভারতেও একই অবস্থা চালু রয়েছে। ড. ফরাসউদ্দিন আরো বলেন, বৈদেশিক মুদ্রার অত্যধিক রিজার্ভ ধরে রেখে ঠিক কাজ করছে না কেন্দ্রীয় ব্যাংক। বর্তমানে ১৭ বিলিয়ন ডলারের মতো বড় অংকের রিজার্ভ ধরে রেখে বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশের কোনো লাভ নেই। একে যে করেই হোক দেশের বিনিয়োগে নিয়ে আসতে হবে। এজন্য সুদের হার কমাতে হবে। তিনি বলেন, মানুষ যাতে খাদ্যের অভাবে না মরে- সে পরিমাণ খাদ্য আমদানির জন্য প্রয়োজনীয় রিজার্ভ জমা থাকলেই যথেষ্ট। কিন্তু গত কয়েক বছরের বাম্পার ফলনের কারণে আমাদের গুদামগুলোতে ১৫ লাখ টনের বেশি খাদ্য মজুদ আছে। আগামী এক-দেড় বছরে কোনো খাদ্য আমদানির প্রয়োজন পড়বে না। সে হিসাবে বিদেশী ব্যাংকে বেশি রিজার্ভ ধরে রাখা ‘বোকামি’ ছাড়া আর কিছু নয় বলে মনে করেন ফরাসউদ্দিন। তার মতে বাংলাদেশে এখন ডলারের সাথে টাকার মান একশ’ টাকা করা না গেলে অন্তত ৯০ টাকা অবশ্যই করা উচিত। এতে বিদেশী পণ্য আমদানি কমে গিয়ে রফতানি বাড়বে। সেই সাথে রফতানিমুখী বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান বাড়বে। পাশাপাশি বাড়বে প্রবাসীদের পাঠানো রেমিটেন্সের পরিমাণও। এর ফলে বাংলাদেশের বিদেশী দাতা নির্ভরতাও কমে যাবে। তিনি বলেন, বিশ্ব অর্থনীতির বর্তমান বিচারে চীনা মুদ্রা মার্কিন ডলারের সমান শক্তিশালী। অর্থাৎ প্রকৃতপক্ষে এক মার্কিন ডলারের প্রায় সমানই হবে চীনের এক ইউয়ান। তারপরেও বাস্তবতা হচ্ছে, বর্তমানে আন্তর্জাতিক বিনিময় হারে এক মার্কিন ডলারের সমান চীনের সাত থেকে আট ইউয়ান। এটা চীনের কেন্দ্রীয় ব্যাংকই করে রেখেছে।

যদিও চীনের মুদ্রার দাম বাড়াতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রবল চাপ রয়েছে। কিন্তু চীনের কেন্দ্রীয় ব্যাংক তা না মেনে ইউয়ানকে যথেষ্ট অবমূল্যায়িত করেই রেখেছে। যার ফলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ সারা দুনিয়ায় চীনের রফতানি এতো বেড়েছে। এটাই চীনাদের মুদ্রা যুদ্ধের সাফল্য। একই অবস্থা জাপানী মুদ্রা- ইয়েনের ক্ষেত্রেও। বিশ্ববাজারে চীনের প্রতিযোগিতা সমতা এর মুদ্রার মানের ওপরও অনেকটা নির্ভরশীল। দশ বছর আগে বৈশ্বিক অর্থনৈতিক ‘বাগবেয়ার’ হিসেবে অভিষিক্ত হয় চীনা মুদ্রা ইউয়ান। ২০০৩ সালের জুনে যুক্তরাষ্ট্রের তখনকার ট্রেজারি সেক্রেটারি জন স্নো চীনকে তার মুদ্রানীতি আরো সহজীকরণে উৎসাহিত করেছিলেন। যে নীতির অধীনে এক ডলারের বিপরীতে ইউয়ান ৮ দশমিক ২৮-এ বিক্রি হতো। পরের মাসে চার মার্কিন সিনেটর উত্তেজিত হয়ে স্নোর কাছে একটি চিঠি লেখেন, যেখানে তাকে চীনের ‘কারেন্সি ম্যানিপুলেশন’ বিষয়ে তদন্ত করার আহ্বান জানানো হয়। নিউইয়র্কের ডেমোক্রেট সিনেটর চার্লস শুমার অভিযোগ তুলে বলেন, চীন ইচ্ছাকৃতভাবে তাদের মুদ্রা অবমূল্যায়িত করে রেখেছে। এক দশক পরও শুমার ও অন্য সিনেটররা ইউয়ানের বিরুদ্ধে তাদের তুবড়ি ছুঁটিয়ে চলেছেন। এদের মধ্যে আটজন সম্প্রতি তাদের সংসদের উচ্চকক্ষ- সিনেটে একটি বিল দাখিল করেছেন, যেখানে কারেন্সি ম্যানিপুলেশনের বিরুদ্ধে শুল্কারোপ করার দাবি জানানো হয়েছে। আর এর পরিণতিতে গত মে মাসে তড়িঘড়ি ডলারের বিপরীতে ইউয়ানের বিনিময় মূল্য ঠিক করা হয় ৬ দশমিক ১২, যা ২০০৩ সালের জুনের হারের চেয়ে ৩৫ শতাংশ শক্তিশালী। জাপানের মুদ্রার বিপরীতেও এর মান বাড়ানো হয়। গত বছরের তুলনায় দুর্বল ইয়েনের বিপরীতে ইউয়ানকে ২০ শতাংশ শক্তিশালী করা হয়। ১০ বছর ধরে চীনের মুদ্রা বড় এক আন্তর্জাতিক বিতর্কে রূপ নিয়েছে। বিশ্ব অর্থনীতিবিদদের মতে, হয়তো আরো ১০ বছর লাগবে ইউয়ানকে পূর্ণমাত্রায় রূপান্তরযোগ্য আন্তর্জাতিক মুদ্রা হিসেবে বিরাজ করতে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের ফরেন রিজার্ভ অ্যান্ড ট্রেজারি ম্যানেজমেন্ট বিভাগের মহাব্যবস্থাপক কাজী সাইদুর রহমান জানান, চলতি অর্থবছরের প্রথম তিন মাসে (পহেলা জুলাই থেকে ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত) একশ কোটি ডলার বাজার থেকে কিনেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। বাজারে ডলারের চাহিদা কমে যাওয়ায় কেন্দ্রীয় ব্যাংক ‘তা’ কিনে রাখছে বলে জানান তিনি। তবে সাম্প্রতিক সময়ে পণ্য আমদানির এলসি খোলার পরিমাণ বেড়ে যাওয়ায় বাজারে ডলারের চাহিদা ফের বাড়তে শুরু করেছে। ২০১২-১৩ অর্থবছরে প্রায় ৫শ’ কোটি ডলার কিনেছিল বাংলাদেশ ব্যাংক। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, গত সপ্তাহ জুড়ে প্রতি ডলার ৭৭ টাকা ৭৫ পয়সায় বিক্রি হয়েছে। গত চার মাস ধরে এই একই দামে ডলার বিক্রি হচ্ছে। সাইদুর রহমান বলেন, বেশ কয়েক মাস ধরে টাকা-ডলারের বিনিময় হার স্থিতিশীল রয়েছে। আর ভারতের মুদ্রাবাজারে বেশকিছু দিন ধরে অস্থিরতা চলছে। আমাদের এখানে সেটা নেই। বাংলাদেশের বাজারে ভারতীয় পণ্যের প্রবেশ প্রসঙ্গে সাইদুর রহমান বলেন, রুপির দর এখন প্রতিদিনই কমছে। সে কারণে বিষয়টি নিয়ে আতঙ্কিত হওয়ার মতো পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। এর ফলে ভারতে বাংলাদেশের পণ্য রফতানি আরো কমে যাবে। অন্যদিকে বাড়তে থাকবে ভারতীয় পণ্যের আমদানি। এতে দু’ দেশের বাণিজ্য ভারসাম্যহীনতা আরো বেড়ে যাবে।