>>ইসলামের দৃষ্টিতে ফরেক্স নিয়ে অনেক লিখা এবং মন্তব্য দেখে শেষ পর্যন্ত লিখতে বসলাম।
এটা নিয়ে একটি টপিক যদিও আছে তারপরও আমি আলাদাভাবে আরেকটি টপিক ওপেন করলাম কারন আমি যখন এই মন্তব্যটি লিখব তখন এটা ওই পোস্ট এ তিন পেইজ পেছনে চলে যাবে, ফলে তিন পেইজ পড়ার ধৈর্য যাদের নেই তাদের কাছে এই লিখাটা নাও পৌছতে পারে। যেহেতু এটা আমি বিজ্ঞ আলেমদের সাথে কথা বলে এবং প্রামাণ্য কিতাব থেকে লিখেছি কাজেই আশা করব প্রিয় তানভীর ভাই বিষয়টি বিবেচনা করবেন।
আমি এই লিখাটা লিখার জন্য জামেয়া রহমানিয়ার(ঢাকা) মুফতি সাহেবের সাথে আমি কথা বলেছি আর ফতোয়ায়ে রহমানিয়া এবং আহকামে জিন্দেগী এই দুইখানা মাসয়ালার কিতাবের সাহায্য নিয়েছি।
বুঝার জন্য আমি একটু বিস্তারিত আলোচনা করব।
==>সম্পদ উপার্জনের নীতিমালা
১. সম্পদ হালাল ও পবিত্র হতে হবে।
২. সম্পদ উপার্জনের কাজে লিপ্ত হয়ে কোন ফরজ বা ওয়াজিব বা সুন্নত কাজে বিঘ্ন না ঘটে।
৩. সম্পদ উপার্জন মোহ বা বিলাসিতার উদ্দেশ্যে নয় বরং নিজের দায়িত্ব পালন ও আল্লাহর রাস্তায় এবং মানুষের কল্যাণে ব্যয় করার নিয়তে উপার্জন করা উচিত। তাহলে এটা ইবাদত বলে গণ্য হবে।
==>সম্পদ সঞ্চয় ও সংরক্ষনের এর নীতিমালা
১. সুদ ভিত্তিক ব্যাংকে টাকা রাখা জায়েজ নয়। যদি আইনগত বাদ্ধবাধকতার কারনে বা নিরুপায় হয়ে রাখতেই হয় তবে অনুমতি রয়েছে।
২. বাংকের সুদের টাকা ব্যাংকে ছেড়ে দিয়ে আসা অন্যায়, কারন ব্যাংক কর্তৃপক্ষ এটাকে মাসায়ালা অনুযায়ী ব্যয় করবে না। তাই এ টাকা তুলে এনে গরিব মিসকিনদের মধ্যে (সওয়াবের নিয়ত ছাড়া) দান করে দিতে হবে।
==>ব্যবসা বানিজ্যের(ফরেক্স) নীতিমালা
১. অর্থদাতা এবং যে কাজ করে দিবে তাদের মধ্যে মুনাফার হার নির্দিষ্ট করে নিতে হবে। এমন যেন না হয় যে, "লাভ ক্ষতি যাই হোক দুজনে মিলে ভাগ করে নেব", এটা করা যাবে না। আগেই সব কিছু পরিস্কার করে নিতে হবে।
ফরেক্সে ইনভেস্টর এবং ব্রোকার এর মধ্যে বিভিন্ন কারেন্সি পেয়ারে স্প্রেড নির্দিষ্ট করা থাকে অথবা একটি রেঞ্জ দেয়া থাকে যেমন সবনিম্ন ১ থেকে সবোচ্চ ২, এই স্প্রেডটাই হচ্ছে ব্রোকারের মুনাফা। যেসব ভাল ব্রোকার এর বিভিন্ন কারেন্সি পেয়ারে স্প্রেড নির্দিষ্ট করা থাকে অথবা একটি রেঞ্জ দেয়া থাকে তাদের সাথে ব্যবসা করা যাবে। কিন্তু যাদের কথা আর বাস্তবতায় মিল নাই তাদের সাথে ব্যবসা করা অনুচিত।
২. যদি দেখা যায় লাভ তো হয় ই নি বরং ক্ষতি হয়েছে তবে তা শুধুমাত্র অর্থদাতার ভাগে পড়বে। আর যদি লাভ ক্ষতি সমান সমান হয় তবে অর্থদাতা চাইলে সব টাকা তুলে নিয়ে যেতে পারবে।
ফরেক্সে ক্ষতি শুধুমাত্র ইনভেস্টর এর। আর যেকোনো সময় ইনভেস্টর তার নিজের টাকা তুলে নিতে পারে। যেসব ব্রোকার এই নীতিমালা মেনে চলবে না বা অর্থ তোলার সময় চার্জ আরোপ করে (বোনাস ব্যতিত) তাদের সাথে ব্যবসা করা অনুচিত।
৩. ব্যবসা সংক্রান্ত সকল খরচ যেমন টাকা জমা, তোলা ইত্যাদি মূলধন থেকে অর্থাৎ অর্থ দাতা বহন করবে।
ফরেক্সে এই সমস্ত খরচ ইনভেস্টর বহন করে।
৪. অবৈধ বস্তু ক্রয় এবং বিক্রয় করা জায়েজ নয়।
ফরেক্সে কোন পেয়ার যদি এই রকম থাকে যা ইসলামে অবৈধ অথবা যেসব ব্রোকার টাকা মেরে দেয় তাদের সাথে ব্যবসা করা যাবে না।
৫. যেসব দ্রব্য বিক্রয় হবে তা সামনে থাকতে হবে, আর যদি কর্মচারী নিযুক্ত করা থাকে আর তারা লেনদেন করে তবে ঠিক আছে, তবে দাম এবং পন্ন্যের বিবরন সুস্পষ্ট ভাবে ব্যক্ত করা থাকতে হবে। একই জিনিসের সাথে একই জিনিসের বদল করা যাবে না, যেমন খারাপ টাকার বদলে ভালো টাকা, স্বর্ণের বদলে স্বর্ণ ইত্যাদি। পণ্য হস্তান্তরের সময় নির্দিষ্ট করা থাকতে হবে।
ফরেক্সে আমরা সাধারণত টাকা বা ডলার ইনভেস্ট করে থাকি। আলেমদের মতে কারেন্সি পেয়ার গুলু পন্যের মত। এক্ষেত্রে আমরা নিজ হাতে টাকা ইনভেস্ট করলে একদেশের কারেন্সির সাথে অন্য দেশের কারেন্সি বদল বা ক্রয় বিক্রয় করতে কোন সমস্যা নেই। আর মেটা ট্রেডারে বাই এবং সেল এর সময়, স্প্রেড ইত্যাদি উল্লেখ করা থাকে কাজেই এটা সমস্যা না। তবে টাকা এবং গোল্ড বা অন্যান্য মেটাল এর মধ্যে একটু পার্থক্য রয়েছে। টাকা বিভিন্ন সময় আমারা বিদেশ থেকে আনা নেয়া করি, শুধুমাত্র এ টি এম কার্ড ব্যাবহার করে বুথ থেকে টাকা তুলতে পারি। কিন্তু ফরেক্স ব্রোকাররা গোল্ড বা সিলভার ইত্যাদি আদৌ কেনা বেচা করে কিনা, না শুধুমাত্র প্রতিযোগিতার জন্য লোক দেখানো কেনাবেচা করে তাতে সন্দেহ আছে। কাজেই পরহেজগারদের জন্য উত্তম হচ্ছে মেটাল ট্রেড না করে কারেন্সি নিয়ে ট্রেড করা।
৬. বৈদেশিক মুদ্রা যেমন ডলার, পাউন্ড ইত্যাদি সরকার নির্ধারিত মুল্যের চেয়ে বেশি মুল্যে ক্রয় বিক্রয় করা জায়েজ।
ফরেক্সে অবশ্যই খেয়াল রাখতে হবে যে দুটি ভিন্ন কারেন্সির মধ্যে যেন লেনদেন হয়, যেমন ডলারের সাথে পাওন্ড, ইউরোর সাথে ডলার ইত্যাদি। ইউ ইস ডলারের সাথে কানাডিয়ান ডলার এক্সচেঞ্জ করা যাবে, তবে যারা পরহেজগারি এখতিয়ার করতে চান তারা এগুলু বাদে অন্য পেয়ারগুলি ট্রেড করতে পারেন।
৮. কাউকে ধার দিয়ে একই সময়ে ওই ধার গ্রহিতার কাছ থেকে ধারদাতা লাভ গ্রহন করতে পারবে না অর্থাৎ ধার গ্রহিতার কাছ থেকে তার মুনাফার অংশবিশেষ দাবি করতে পারবে না। করলে তা সুদ বলে গণ্য হবে।
মনে করুন আপনি একজনের কাছ থেকে ১০০০টাকা ধার নিলেন, কিন্তু তার জন্য আবার সে ১০০ টাকা বেশি ফেরত দাবি করল বা বলল যে ১০০ টাকা তাকে আগেই ফি দিতে হবে অথবা বলল যে ব্যবসার লভ্যাংশ থেকে তাকে ক% দিতে হবে। সেক্ষেত্রে এটা সুদ হবে এবং নাজায়েজ হবে। লেভারেজ এর ক্ষেত্রে সাধারণত ব্রোকার ট্রেডারের প্রফিট এর কোন অংশ দাবি করে না এবং একইভাবে ব্রোকার লস এর কোন অংশও নেয় না, এটা ঠিক আছে। যদি কোন ব্রোকার লেভারেজ এর জন্য ফি বা কমিশন দাবি করে তবে তাদের সাথে ব্যবসা করা যাবে না। ধরুন আপনি লেভারেজ ছাড়া আপনার মূলধন অনুপাতে ১ মাইক্রো লট এ ট্রেড করতে পারেন, সেক্ষেত্রে একটি eur/usd ট্রেড এর জন্য ব্রোকারের মজুরি হবে প্রায় 20 সেন্ট (স্প্রেড ২)। আবার আপনি ১:১০০ লেভারেজ নিয়ে ১ স্ট্যান্ডার্ড লট এ ট্রেড করতে পারেন, সেক্ষেত্রে একটি eur/usd ট্রেড এর জন্য ব্রোকারের মজুরি হবে প্রায় 20 ডলার (স্প্রেড ২)। এখানে আপনার লাভ যেমন ১০০ গুন, তেমনি ব্রোকারের লাভও ১০০ গুন। এই ব্যপারটাতে অনেক আলেম আপত্তি করেন যে, ব্রোকার এখানে আপনাকে ধার দেয়ার মাধ্যমে নিজে লাভবান হচ্ছে। কিন্তু আদৌ কি এটা ধার? কারন ব্রোকার এক্ষেত্রে তার টাকা ফেরত চাচ্ছে না।
আবার যদি এই ভাবে চিন্তা করা হয় যে বড় লটে ট্রেড করার জন্য ব্রোকারের মজুরি বেশি দেয়া হচ্ছে তখন তা আর সমস্যা থাকে না। কারন লেভারেজ ছাড়াও যদি আপনি বড় লটে ট্রেড করতেন তবে আপনাকে বেশি মজুরি দিতে হত। এমনিতেই লেভারেজ নেয়া ভালো না, আর যদি আপনি পরহেজগারি এখতিয়ার করতে চান তবে তো লেভারেজ না নিলেই হবে। যদি বেশি ইনভেস্ট করার সামর্থ্য না ই থাকে তবে অল্প লেভারেজ নিয়ে ট্রেড শুরু করা যেতে পারে আর এই নিয়্যত রাখতে হবে যখন সামর্থ্য হয়ে যাবে তখন লিভারেজ না নিয়েই ট্রেড করব ইনশাআল্লাহ্*। অবশ্যই আল্লাহ তায়ালা খালেস নিয়্যতকারিকে এবং পরহেজগারকে বড় ইনভেস্ট করার তৌফিক দান করবেন।
আল্লাহপাক আমাদের সবাইকে হালাল এবং উত্তম রিজিকের ব্যবস্থা করে দিন। আমীন।