PDA

View Full Version : মাজদা সিএক্স-৩০ ( Mazda CX-30) গাড়ির রিভিউ



FXBD
2021-02-10, 10:04 AM
13647
মাজদা হচ্ছে এমন একটা ব্র্যান্ড, এরা সবসময়ই কম বাজেটের মধ্যে সবচেয়ে লাক্সারিয়াস জিনিস কাস্টমারদের দিয়ে থাকে। সেগমেন্টের অন্যতম সুন্দর ও লাক্সারিয়াস জাপানী গাড়িগুলো তারাই বানায়, তাও আবার সবচেয়ে কম দামে। সেডান হোক আর এসইউভি, প্রত্যেকটি সেগমেন্টেই জাপানের অন্য যেকোনো অপশনের চেয়ে মাজদার গাড়িগুলো সবসময়ে সবচেয়ে কমদামী হয়। উদাহারণ -> ২০১৬ মডেলের প্রিমিও/এলিওনের দাম যেখানে ২৮ লাখ টাকা, সেখানে ২০১৬ মডেলের মাজদা এক্সিলার দাম ২২ লাখ টাকা! কিন্তু এদিকে এক্সিলা চালিয়ে মজা ও চড়ে আরাম প্রিমিও/এলিওনের চেয়ে বেশি, সাথে এক্সিলা তেলও খায় কম, বেশি পাওয়ারফুল, ও জার্মান গাড়ির মতো লেটেস্ট প্রযুক্তিতে ভরপুর। যাইহোক, সিএক্স-৩০ গাড়িটিও ব্যাতিক্রম নয়। ব্যাক্তিগতভাবে এই সি-সেগমেন্টে আমার সবচেয়ে প্রিয় গাড়ি হলো সিএক্স-৩০। কিন্তু তাই বলে এই পোস্টে কোথাও কিন্তু পার্শিয়ালিটি খুঁজে পাবেন না! যাইহোক, অনেক কথা বললাম, রিভিউ শুরু করে দিচ্ছি এবার।
সিএক্স-৩০ এর ইঞ্জিন অপশন ৩টি :- ১) ১৮০০ সিসির ডিজেল; ২) ২০০০ সিসির নন-হাইব্রিড অকটেন; ৩) ২০০০ সিসির মাইল্ড-হাইব্রিড অকটেন ইঞ্জিন। কিন্তু, ১৮০০ সিসি ও ২০০০ সিসির নন-হাইব্রিড ব্র্যান্ড নিউ কিনতে গেলে আমাদের দেশে যেই দাম পড়বে, তাতে রিকন্ডিশন্ড হ্যারিয়ার হাইব্রিড পাওয়া যায়। তাই এখানে শুধু মাইল্ড-হাইব্রিডটির দাম বলবো। যেহেতু জাপানে ২০১৯ সালের অক্টোবরে গাড়িটির বিক্রি শুরু হয়, তাই ২০২৩ সাল থেকে গাড়িটির রিকন্ডিশন্ড ইউনিট সহজেই বাংলাদেশে আনা যাবে। তখন দাম পড়বে ৪৫ লাখের আশেপাশে। আজকে রিভিউটিও দিবো মাইল্ড হাইব্রিড ভ্যারিয়েন্টটির।
মাজদার অন্য সব গাড়ির মতোই সিএক্স-৩০ দেখতে খুবই স্পোর্টি। দৈর্ঘ্যে ও উচ্চতায় এই সেগমেন্টের জাপানী অপশনগুলোর চেয়ে ছোট, কিন্তু মনে রাখবেন যে স্পোর্টি গাড়িগুলো কিন্তু একটু ছোটই হয়। সামনে ও পিছনে চিকন শেপের লাইটস, হেডলাইট থেকে একটা নিকেল বিট এসে গ্রিলের নিচের অর্ধেকে একটা বর্ডার দেওয়া। পিছনের অংশটি বেশ কার্ভি, যেটি দেখতে ২০২১ মডেলের হ্যারিয়ারের পিছনের বডি শেপের মতো। ডুয়েল-টিপ স্টেইনলেস স্টিল সাইলেন্সার মাফলার আছে, যা গাড়িটির পিছনের লুককে স্পোর্টি করে। একটা বড় খুঁত হচ্ছে, গাড়ির চারপাশ জুড়ে কালো রঙের একটি বডিকিট দেওয়া, যেটি গাড়িটিকে একটু সস্তা-সস্তা লুক এনে দেয়। একটি সুন্দর ফিচার হচ্ছে, ইন্ডিকেটর লাইটগুলো নরমাল সব গাড়ির মতো একবারে অন হয় ও এক পলকে অফ হয় না, একটু একটু করে ব্রাইটনেস বাড়ায়, আবার অল্প অল্প করে ব্রাইটনেস কমিয়ে নিভে যায়। এভাবেই প্রত্যেকবার জ্বলে ইন্ডিকেটরটি। 4WD মডেলে হেডলাইট-ওয়াশার থাকে, যেন কেউ অফ-রোডিং করলে হেডলাইটে কাদামাটি লেগে গেলে যেন এই পিচকারী দিয়ে হেডলাইট পরিষ্কার করা যায়। সামনের চাকার উপরের যেই বডির অংশ, যেটাকে বলে ফেন্ডার, তার উপরে “SkyActiv-X” লেখা থাকে; ও পিছনে ডানপাশে থাকে “e-SkyActiv X” লেখা একটি ব্যাজ থাকে। গাড়িটির প্রত্যেকটি ট্রিমেই ১৮” সাইজের চাকা থাকে, যা দেখতে বেশ স্ট্যান্ডার্ড।
ইন্টেরিওরে নিঃসন্দেহে সিএক্স-৩০ এই সেগমেন্টের জাপানিজ গাড়িদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি লাক্সারিয়াস। প্রত্যেকটা ট্রিমেই সাদা ও কালো রঙের মধ্যে যেকোনো একটি বেছে নেওয়ার সুযোগ দিচ্ছে মাজদা, এবং হাইয়েস্ট ট্রিম “100th Anniversary Special”-এ থাকছে মেরুন লাল রঙের সিট। প্রত্যেকটা ট্রিমেই পাওয়ার সিট ও হিটেড সিট থাকে। নিসান কাশকাই ও মিতসুবিশি এক্লিপ্স ক্রসে রেয়ার এসি ভেন্টস না থাকলেও টয়োটা করোলা ক্রসের মতো মাজদা সিএক্স-৩০ গাড়িটির পিছনের সারিতে এসি আছে। যেখানে সারা দুনিয়া এখন একটা সিম্পেল এসি চালানোর কাজও টাচস্ক্রিনের মাধ্যমে করার ব্যাবস্থা করে রেখে দেয় অতি-আধুনিক দেখানোর জন্য, সেখানে মাজদা একদম সাধারণ বাটন ও ডিজিটাল ডিসপ্লে দিয়েছে এই সাধারণ কাজগুলো করার জন্য। এটি করার কারণ হিসেবে মাজদা বলেছে যে, তারা অতি-আধুনিকতায় গা ভাসাতে গিয়ে গাড়ির ড্রাইভারের মনোযোগ রিস্কে ফেলাতে পারবে না কোনোভাবেই। আর এই কারণেই ২০১৮ পর্যন্ত যত মাজদা আছে, সেগুলোর সিডি প্লেয়ারের স্ক্রিন সাধারণ টাচ ও অডির মতো ডায়াল সিস্টেম ২টিই থাকলেও ২০১৯-এর পর থেকে সব গাড়িতেই তারা স্ক্রিন থেকে টাচ কন্ট্রোল উঠিয়ে দিয়েছে, এখন থেকে শুধু গিয়ার লেভারের পিছনে থাকা ডায়াল ও বাটনগুলো দিয়েই এই স্ক্রিনটি কন্ট্রোল করা যাবে। কিন্তু একটা খুঁত হচ্ছে, যদি ড্রাইভারের পাশে বসা কেউ এই স্ক্রিনে কিছু চালু করতে চায়, তাকে বেশ বেগ পোহাতে হবে। কারণ, প্রথমত স্ক্রিনটি ড্রাইভারের দিকে ফেরানো, তাই পাশের সিট থেকে স্ক্রিনটি দেখা একটু মুশকিল হবে। দ্বিতীয়ত, যেহেতু স্ক্রিনে টাচ-এর কোনো অপশন নেই, তাই তাকে এই ডায়াল দিয়ে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে কন্ট্রোল করতে হবে যা বেশ বিরক্তিকর।
মাজদা সিএক্স-৩০ গাড়িটিতে আছে ২০০০ সিসির ৪-সিলিন্ডারের মাইল্ড হাইব্রিড ইঞ্জিন, যার শক্তি ১৭৮ হর্সপাওয়ার ও ২২৪ নিউটন-মিটার টর্ক। ফ্রন্ট-হুইল-ড্রাইভ ও ফোর-হুইল-ড্রাইভ ২টিই অ্যাভাইলেবল, ও গিয়ারবক্সও ২ রকমের অ্যাভাইলেবল :- ১) ৬-গিয়ারের ম্যানুয়াল ট্রান্সমিশন, ২) ৬-গিয়ারের অটোম্যাটিক ট্রান্সমিশন। এখানে একটা অসুবিধা হচ্ছে, গাড়িটি ২০০০ সিসি হওয়ার কারণে AIT-এর পরিমাণ হবে বছরে ৫০ হাজার টাকা। গাড়িটির ফুয়েল মাইলেজের ব্যাপারে পরবর্তী অনুচ্ছেদে বলা হচ্ছে।
এই গাড়িটির যেই ভ্যারিয়েন্টের আমরা এখন রিভিউ করছি, সেটার ইঞ্জিনের নাম হলো SkyActiv-X। এখন, মাজদার গ্যাসোলিন অর্থাৎ অকটেন-চালিত ইঞ্জিনের নাম SkyActiv-G এবং ডিজেল-চালিত ইঞ্জিনের নাম SkyActiv-D। তাহলে এই ইঞ্জিনটির নামে “X” কেন আছে? কারণ, এই ইঞ্জিনটি হলো মাজদার এক অদ্ভুত আবিষ্কার, যেটাতে অকটেন ইঞ্জিন ও ডিজেল ইঞ্জিন ২টিরই কাজের প্রোসেস সমন্বয় করা হয়েছে। সাধারণত ডিজেল ইঞ্জিনের ফুয়েল ইকোনমি সবসময়ে খুব ভালো হয়, কারণ ডিজেল ইঞ্জিনে বাতাস বেশি প্রবেশ করানো হয় ও তেল কম। কিন্তু কম তেল সিলিন্ডারে প্রবেশ করলেও বেশি বাতাসের কারণে যখন পিস্টন উপরে উঠে, তখন প্রচন্ড হিট ও প্রেশারে এই তেল-বাতাসের মিশ্রণ নিজেই বিস্ফোরিত হয়ে যায়, স্পার্ক প্লাগের আর প্রয়োজন হয়না। এই সিস্টেমকে বলে ‘কম্প্রেশন ইগনিশন’। কিন্তু অকটেন ইঞ্জিনে যেই পরিমাণে তেল ও বাতাস সিলিন্ডারে ঢালা হয়, তা বিস্ফোরণ করার জন্য দরকার স্পার্ক প্লাগ। এই সিস্টেমকে বলে ‘স্পার্ক ইগনিশন’। এখন মাজদা করেছে কি, এই দুইটি সিস্টেমের ভালো দিক গুলোকে এক জায়গায় করে একটি নতুন সিস্টেম বানিয়েছে, যার নাম ‘স্পার্ক-কন্ট্রোল্ড কম্প্রেশন ইগনিশন’। এখানে যেটা হয় :- ডিজেল ইঞ্জিনের মতো সিলিন্ডারের মধ্যে অকটেনের চেয়ে বাতাস বেশি ঢুকে, ও ঢুকার পর স্পার্ক প্লাগ খুবই সামান্য একটি আগুনের ফুলকি ছাড়ে, যা নরমাল ইঞ্জিনে বিস্ফোরণ ঘটিয়ে দেওয়ার মতো আগুনের চেয়ে অনেক কম; কিন্তু এই অল্প আগুনের ফলে তেল-বাতাসের মিশ্রণটি ডিজেলের মতো অত্যন্ত গরম হয়ে যায়, যার কারণে পিস্টন উপরে উঠে আসলে ডিজেল ইঞ্জিনের মতো নিজে নিজেই বিস্ফোরণ ঘটিয়ে দেয়। ফলাফল? সাধারণ যেকোনো অকটেন-চালিত নন-হাইব্রিড ইঞ্জিনের চেয়ে ৩০% বেশি ফুয়েল ইকোনমি ও ১০% বেশি শক্তি। এখন ইঞ্জিন তো কোনোরকমের হাইব্রিড সিস্টেমের সহযোগিতা ছাড়াই ৩০% বেশি ফুয়েল ইকোনমি দিচ্ছে, তার উপর আরো ফুয়েল ইকোনমি বৃদ্ধি করতে মাজদা গাড়িটিতে দিয়েছে মাইল্ড-হাইব্রিড সিস্টেম। সাধারণ হাইব্রিড গাড়ির চেয়ে মাইল্ড-হাইব্রিডের ব্যাটারি অনেক ছোট হয়; ও সাধারণ হাইব্রিডে যে ব্যাটারি থেকে গাড়িকে চালানোর শক্তি আসে, মাইল্ড-হাইব্রিডে তা আসে না। তাহলে কিভাবে মাইল্ড-হাইব্রিড তেল বাঁচায়? একটা নন-হাইব্রিড গাড়ির এসি চালাতে, হেডলাইট-টেইললাইট জ্বালাতে, গাড়ির ইন্টেরিওরের মধ্যে আলো জ্বালাতে ও সিডি প্লেয়ার চালানোর জন্য থাকে একটি ব্যাটারি, ও এই ব্যাটারি থেকেই গাড়ির ইঞ্জিন স্টার্ট দেওয়ার ইগনিশনের শক্তি আসে। কিন্তু এই ব্যাটারি চার্জ নেয় তেলের ইঞ্জিন থেকে, ও চার্জ সাপ্লাই দেওয়ার জন্য ইঞ্জিনকে তেল পুড়িয়ে শক্তি উৎপন্ন করতে হয়। এখন, মাইল্ড-হাইব্রিডে সবকিছু নন-হাইব্রিডের মতোই হয়, কিন্তু ব্যাটারির চার্জটা ইঞ্জিন থেকে আসে না, আসে ব্রেক করার ফলে ব্রেকশুতে উৎপন্ন তাপ থেকে। ফলে ইঞ্জিনকে বাড়তি তেল পুড়িয়ে ব্যাটারি চার্জ দেওয়া লাগে না। তাই এসি চালালে ও হেডলাইট জ্বালালে তেল পুড়বে না, এবং এই ব্যাটারি থেকে শক্তি নিয়েই জ্যামে দাঁড়ালে গাড়ি ইঞ্জিন বন্ধ করে রাখবে তেল নষ্ট না করে। সব মিলিয়ে গাড়িটি ফুয়েল ইকোনমি দিবে ঢাকা শহরে ১২ কিমি/লিটারের আশেপাশে। তার উপর মাইল্ড-হাইব্রিড হলেও গাড়িটির ইম্পোর্ট ট্যাক্স হবে অন্য সব হাইব্রিড গাড়ির মতো, যা নন-হাইব্রিডের চেয়ে অনেক শতাংশ কম।
সব মাজদার মতোই গাড়িটি চালিয়ে ও চড়ে বেশ মজাদার। এক্সিলার মতো এতেও বডিরোল খুবই কম, যা কর্নারে কনফিডেন্স এনে দেয়। স্টিয়ারিংটি স্পিড বাড়ার সাথে সাথে নিজ থেকেই হেভি হতে শুরু করে, তাই লো-স্পিডে যেমন আঙুল দিয়েও ঘুরিয়ে ফেলা যাবে আবার হাই-স্পিডেও শক্ত হয়ে যাবে কন্ট্রোল হাতের মুঠোয় রাখতে। সাস্পেনশন হলো সামনে ম্যাকফার্সন স্ট্রাটস ও পিছনে টয়োটা করোলা ক্রসের মতো টরশন বিমস। টরশন বিমে কমফোর্ট একটু কম থাকে, রাস্তা বেশি খারাপ হলে করোলা ক্রসের মতোই এতে একটু আনকমফোর্টেবল লাগবে। এই ক্ষেত্রে মিতসুবিশি এক্লিপ্স ক্রস এগিয়ে আছে মাল্টি-লিংক সাস্পেনশন নিয়ে।
অবশেষে, আমাদের অভিমত। গাড়িটি নিঃসন্দেহে খুবই ভালো। ইন্টেরিওর খুবই লাক্সারিয়াস, ড্রাইভার’স পয়েন্ট অফ ভিউ থেকে চালিয়েও বেশ মজা, আবার ইঞ্জিনটি বেশ পাওয়ারফুল ও ফুয়েল ইফিশিয়েন্ট। কিন্তু আমরা কি গাড়িটি নিতে সাজেস্ট করবো যদি ২০২৩ থেকে গাড়িটি ৪০-৪৫ লাখ টাকায় পাওয়া যায়? না। কারণ, আমাদের দেশে এমনিতেই মাজদার পার্টস নিয়ে সবার হাহাকার, সেখানে এই নতুন প্রজন্মের ইঞ্জিনটির পার্টস পাওয়া খুবই টাফ হবে আমাদের দেশে। এর চেয়ে এই দামে নিসান এক্স-ট্রেইল হাইব্রিড অনেক ভালো চয়েজ, ও যদি এই সেগমেন্টের মধ্যেই বলতে হয়, তাহলে বাজেট আরেকটু বাড়ালেই টয়োটা করোলা ক্রস পাওয়া যাবে যেটিতে প্রিয়াসের একই ইঞ্জিন থাকার কারণে ফুয়েল ইকোনমি বেটার হবে ও পার্টস অনেক অ্যাভাইলেবল থাকবে।