PDA

View Full Version : সৌন্দর্যের সন্দ্বীপ



Montu Zaman
2023-02-23, 12:28 PM
http://forex-bangla.com/customavatars/1750975137.gif
জীবন সুন্দর নয়। জীবনটাকে সুন্দর করে নিতে হয়। আর এই সুন্দরের মূলমন্ত্র, মাঝেমধ্যেই উজাড় করা প্রকৃতির সান্নিধ্যে নিজেকে বিলিয়ে দেওয়া। সেই চেতনা থেকেই হুটহাট করে ছুটে গিয়েছিলাম সৌন্দর্যের লীলাভূমি সন্দ্বীপ। কোনো পূর্ব পরিকল্পনা ছিল না। ইচ্ছা ছিল যেখানকার টিকিট পাব সেদিকেই ছুটব। যাওয়ার দিন ট্রেন, বাস ও জাহাজ কোনো বাহনেরই টিকিট নেই। নেই, নেই, নেই। অতঃপর ফকিরাপুলের আরিফ ভাইয়ের বদান্যতায় চিটাগাংয়ের দুটি টিকিট ম্যানেজ হতেই রাকিবকে সঙ্গী করে রাত সাড়ে ১০টার বাসে চেপে বসলাম। তখনও মাথায় ঘুরপাক চলছিল কোথায় যাব। শেষমেশ কুমিরা গিয়ে রাত প্রায় ৩টায় নেমে যাই। সিএনজিতে চড়ে কুমিরা নৌ-টার্মিনাল ঘাট। ভোর ৭টার আগে ট্রলার-স্পিডবোট কোনো কিছুই মিলবে না। কী আর করা। কিছুক্ষণ পায়চারী করে হ্যামোকটা ফ্লোরে বিছিয়ে আমি আর রাকিব ভ্যানগাড়িটাকে খাট ভেবে শুয়ে পড়ি। হ্যামোকের কাপড় ভেদ করে ফ্লোরের হিমহিম ঠান্ডা শরীরে আছড়ে পড়ে। বাহ্* কী আনন্দ। উড়ে এসে জুড়ে বসা কনকনে বাতাস সঙ্গী করে, এপাশ-ওপাশ করতে করতেই ফজরের আজান পড়ে। যাই মসজিদে। জামাতে নামাজ আদায় শেষে এসে দেখি টার্মিনালে বেশ যাত্রী। সাগরের কোলঘেঁষা পন্টুনে ভোরের আলোয় হাঁটি। একদা সাগর-মহাসাগরের বুক চষে বেড়ানো বড় বড় জাহাজগুলো স্ট্ক্র্যাপ করার জন্য এই ঘাটেই নোঙর করে রাখা হয়। স্পিডবোটে চড়ার জন্য ঘাটের সেতুটাও বেশ দৃষ্টিনন্দন। হাঁটতে হাঁটতে মনে হবে যেন আপনি সোজা সাগরের বুকে এগিয়ে যাচ্ছেন।
সেদিন কুয়াশা একটু বেশিই ছিল। তাই প্রথম বোট ছাড়ল ৭টার বদলে ৮টায়। আমাদের টিকিটপ্রাপ্তির সিরিয়াল দেরি হওয়ায় বোটে চড়তে হলো খানিকটা সময় পরে। বোটে থাকা ছেঁড়া, নোংরা লাইফ জ্যাকেটগুলোই যাত্রীরা সবাই পরে নিলাম। ২২ জন যাত্রী নিয়ে বঙ্গোপসাগরের বুক চিরে স্পিডবোট মাত্র ২০ মিনিটে নামিয়ে দিল সন্দ্বীপ নৌ-টার্মিনাল ঘাটে। জেটিতে পা রাখতেই বেশ ভালো লাগে। টার্মিনালের আশপাশ গোট্টাছড়া ঘাট ও সাগরপাড়ের ম্যানগ্রোভ বেশ হাতছানি দেয়। ভ্যানগাড়িতে না উঠে, হাঁটতে হাঁটতেই সিএনজি স্ট্যান্ডে যাই। ভাড়া দরদাম করে উঠে পড়ি। গন্তব্য কালাপানিয়া।
যেতে যেতে পথে পথে থামি। সোঁদা মাটির ঘ্রাণ নিই। খড়কুটোর সঙ্গে দেহটাকে আলিঙ্গন করি। কখনোবা আবার তেলে ভাজা মচমচা পরোটা-ভাজি আর মহিষের দুধের দই, মিষ্টি দিয়ে উদোর পূর্তি করি। এ রকমটা করতে করতেই পৌঁছে যাই কালাপানিয়া বেড়িবাঁধ। স্থানীয়দের সহায়তায় দ্রুত মেঘনার মোহনার তীরে জনমানব শূন্য নারকেল-খেজুর গাছঘেরা স্থানে তাঁবু ফেলি। আজকের রাতটা কাটবে এখানেই। তাঁবু টানিয়ে ছুটলাম আশপাশ পরিদর্শনে। ততক্ষণে একপাল শিশুও আমাদের সঙ্গী। দে ছুট। ভ্রমণ সংঘ দূর বহুদূর যেথায় যাক না কেন, স্থানীয়দের সঙ্গে ভাব জমাতে সময় লাগে না তেমন। জুমাবার তাই খুব বেশি দূরে যাই না। দেখা হয় প্রায় ৯০ বছর আগে প্রতিষ্ঠিত কালাপানিয়া হেদায়েতুল উলুম মাদ্রাসা প্রাঙ্গণে। জনশ্রুতি রয়েছে, এই মাদ্রাসার কাছাকাছি এসেই মেঘনার ভয়াবহ ভাঙনের তাণ্ডব বন্ধ হয়েছিল। মাদ্রাসার জনৈক হুজুরের আহ্বানে হাজার হাজার গ্রামবাসী বাঁশ পুঁতেছিল। এরপর আর মেঘনার করাল গ্রাস এদিকটায় আগায়নি। বর্তমানে সেখানে বিশাল চর জেগেছে। স্থানীয় সমাজকর্মী ওমর ফারুকের ভাষ্যমতে, চরের পরিধি যে হারে বাড়ছে তাতে হয়তো একসময় নোয়াখালী জেলার সঙ্গে গিয়ে ঠেকবে।
মূল ভূখণ্ড হতে বিচ্ছিন্ন সন্দ্বীপে প্রায় তিন হাজার বছর ধরেই জনবসতি রয়েছে। এর প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামও মুগ্ধ হয়েছিলেন। একসময় এখানে লবণশিল্প, জাহাজ নির্মাণ কারখানা ও বস্ত্রশিল্পের খ্যাতি বিশ্বব্যাপী ছিল। তুর্কি সাম্রাজ্যের সুলতান পর্যন্ত সন্দ্বীপে নির্মিত জাহাজের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে এখান থেকে বেশ কিছু জাহাজ সংগ্রহ করেছিলেন। বহির্বিশ্বের ভ্রমণতরী ও বাণিজ্যিক জাহাজও সন্দ্বীপে নোঙর ফেলত। সেই সুবাদে পুর্তগিজদের লোলুপ দৃষ্টি পড়ে সন্দ্বীপের ওপর। গড়ে তোলে নিজেদের উপনিবেশ অঞ্চল। এরপর ১৬১৫ সালে পুর্তগিজদের সঙ্গে আরাকান রাজ্যের যুদ্ধে ২০০ সৈন্যসহ পুর্তগিজ সেনাপতি ইমানুয়েল মার্তুস নিহত হলে তারা সন্দ্বীপ ছেড়ে গেলে, ১৬১৬ সালে মগরাজ সন্দ্বীপ দখলে নেয়। এরপর আরাকান ও মগদের প্রাধান্য থাকলেও তাদের পরাধীনতা অস্বীকার করে এ অঞ্চল প্রায় অর্ধশতাব্দী রাজত্ব করে দেলোয়ার খাঁ। বিখ্যাত পর্যটক ইবনে বতুতাসহ পৃথিবীর অনেক পর্যটক সন্দ্বীপের সৌন্দর্যে আকৃষ্ট হয়ে এখানটাতে এসে মুগ্ধ হয়েছিলেন। মুগ্ধ না হয়ে কী আর উপায় আছে। বর্তমান সন্দ্বীপের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য দেখেই অনেকটা অনুমান করা যায়, শত বছর আগের সন্দ্বীপ যে আরও অনেক বেশি প্রকৃতির নৈসর্গিক ভান্ডার ছিল, তা ভেবেচিন্তে ছাড়াই বলা যায়।
পঞ্চদশ শতাব্দীর প্রায় ৬৩০ বর্গমাইলের সন্দ্বীপ ক্রমাগত নদীভাঙনের শিকার হতে হতে বর্তমানে অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার লড়াইয়ে অবতীর্ণ মাত্র ৮০ বর্গমাইল আয়তনের নয়নাভিরাম সন্দ্বীপে ভ্রমণপিপাসুদের জন্য ক্যাম্পিং করে থাকার জন্য কালাপানিয়া, হরিশপুর ও রহমতপুর বেস্ট। অসাধারণ প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে মোড়ানো। সারিসারি নারকেল, খেজুর গাছের ফাঁক গলে দিনে সূর্যের আর রাতে চাঁদের আলোয় মনটাকে ভাসিয়ে নিয়ে যাবে অপার্থিব সুখে। কী বিশ্বাস হচ্ছে না? সবুজ ঘাসে শুয়ে-বসে আমার কিন্তু সে রকমটাই মনে হয়েছে। আমি নিশ্চিত সন্দ্বীপের নজরকাড়া প্রাকৃতিক রূপের ভান্ডার ভ্রমণপিপাসুদের বিমোহিত করবেই।
যাবেন কীভাবে
ঢাকা-চট্টগ্রামের বাসে চড়ে নেমে পড়বেন সীতাকুণ্ড উপজেলার কুমিরা। সেখান থেকে অটো-সিএনজি করে কুমিরা নৌ-টার্মিনাল। সকাল ৭টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত সন্দ্বীপে স্পিডবোট চলাচল করে। সন্দ্বীপের গোট্টাছড়া ঘাট থেকে সিএনজিতে চড়ে কালাপানিয়া বেড়িবাঁধ, হরিশপুর কিংবা রহমতপুর যাওয়া যাবে।