বিদেশী বিনিয়োগ আকর্ষণে অর্থনৈতিক কাঠামোকে নতুন করে সাজাতে হবে
[IMG]http://forex-bangla.com/customavatars/2089320379.jpg[/IMG]
ইকোনমিক রিফর্ম সামিটে বক্তারা বক্তব্য দেন, বাংলাদেশের অর্থনীতির আকারের তুলনায় বিদেশী বিনিয়োগ কম। দেশের বিনিয়োগ নীতিমালা খুবই আকর্ষণীয় হলেও বাস্তবায়নের বেলায় সফলতা খুবই নগণ্য। সাম্প্রতিক সময়ে দেশের সরকারি ও বেসরকারি—উভয় খাতেই ঋণ প্রবৃদ্ধি কমেছে। সার্বিক দিক থেকে বাংলাদেশ একটা অদক্ষতার বেড়াজালে পড়ে গেছে। এখান থেকে বেরিয়ে প্রত্যক্ষ বিদেশী বিনিয়োগ বাড়াতে হলে পুরো অর্থনৈতিক কাঠামোকে নতুন করে সাজাতে হবে।
গতকাল রাজধানীর একটি হোটেলে ‘ইকোনমিক রিফর্ম সামিট-২০২৫’ শীর্ষক সম্মেলনের প্রথম দিনে এসব কথা বলেন বক্তারা। দুদিনব্যাপী এ সম্মেলন যৌথভাবে আয়োজন করে ভয়েস ফর রিফর্ম, বাংলাদেশ রিসার্চ অ্যানালাইসিস অ্যান্ড ইনফরমেশন নেটওয়ার্ক (ব্রেইন), ইনোভিশন কনসাল্টিং, ফিনটেক সোসাইটি ও নাগরিক কোয়ালিশন। দেশের সামগ্রিক উন্নয়ন ও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার স্বার্থে অর্থনৈতিক সংস্কারকে জাতীয় আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে আনার জন্য এ সম্মেলনের আয়োজন করা হয়।
সম্মেলনের মূল সমন্বয়ক ফাহিম মাশরুরের সঞ্চালনায় প্রথম দিনে মোট চারটি অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয়। ‘এসেনশিয়াল রিফর্মস ফর রিমুভিং ইনভেস্টমেন্ট ব্যারিয়ারস’ শীর্ষক প্রথম অধিবেশনে প্রধান অতিথি ছিলেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী। তিনি বলেন, ‘আগামী দিনে আমাদের মূল অর্থনৈতিক পরিকল্পনায় নতুন মডেলে যেতে হবে। যে মডেল চলেছে সেটি বিগত সময়ে নির্দিষ্ট কিছু গোষ্ঠীর জন্য কাজ করছে, সাধারণ মানুষের জন্য কাজ নয়। আমাদের নিশ্চিত করতে হবে অর্থনীতি সবার জন্য। দেশের উন্নয়নে যদি সব মানুষের অংশীদারত্ব না থাকে ও জনগণের উপকার না হয়, সে অর্থনৈতিক মডেল টেকসই হবে না।’
শুধু উৎপাদন ও অবকাঠামোগত বিনিয়োগের বাইরে গিয়ে অর্থনীতিকে ভিন্নভাবে দেখারও আহ্বান করেন সাবেক এ বাণিজ্যমন্ত্রী। তিনি বলেন, ‘জিডিপিতে খেলাধুলার বিরাট অবদান রয়েছে। দেশের তরুণদের এর মাধ্যমে অর্থনীতিতে যুক্ত করতে হবে। আমাদের আইটি রিলেটেড ব্যবসাও তৈরি করতে পারি। পাশাপাশি সরকারি-বেসরকারি অংশীদারত্ব নিশ্চিত করতে হবে। বিএনপি সরকার গঠন করলে সরকারের হাত থেকে প্রতিষ্ঠানের নিয়ন্ত্রণ কমিয়ে এনে বেসরকারি খাতকে প্রাধান্য দেয়া হবে।’
নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থায় আমলাতন্ত্রের দায়িত্ব কমিয়ে আনার পক্ষেও মত দিয়েছেন আমীর খসরু। তিনি বলেন, ‘*দেশের আমলাতন্ত্রের মূল কাজ হওয়া উচিত নীতি বাস্তবায়ন করা, নীতি তৈরি করা নয়। এ দুই ভূমিকার মিশ্রণ দীর্ঘদিন ধরে কার্যকারিতা ও জবাবদিহিকে ব্যাহত করছে। দায়িত্ব নির্দিষ্ট করে দেয়া ও বাস্তবায়নের লক্ষ্য স্পষ্ট করা হলে দক্ষতা বাড়বে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায় এনবিআরকে দুই ভাগ করা হয়েছে। তাতে কী লাভ হয়েছে? বাংলাদেশের মানুষ ও ব্যবসায়ীরা কীভাবে আয় ও ব্যয় করে, একটা ব্যবসার পেছনে কী পরিমাণ শ্রম যায় এনবিআরের আমলারা কি সেটা জানে? যারা মানুষের জন্য করনীতি করবে, জনগণের বিষয়গুলো তাদের মাথায় থাকতে হবে। বিএনপি এগুলো নিয়ে অন্যভাবে চিন্তা করছে। নীতি তৈরি ও প্রণয়ন সবার অংশীদারত্বে হবে, কোনো আমলাতন্ত্রের মাধ্যমে নয়।’
তিনি আরো বলেন, ‘বিএনপি ক্ষমতায় গেলে অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ বিলুপ্ত করা হবে। এ বিভাগ তৈরি করা হয়েছে রাষ্ট্রীয় ব্যাংকগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করতে। এর উদ্দেশ্য ছিল এমডি নিয়োগ ও পর্ষদে পছন্দের লোক বসিয়ে লুটপাট করা।’
প্রথম অধিবেশনে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন সিএফএ সোসাইটি বাংলাদেশের সভাপতি আসিফ খান। তিনি বলেন, ‘মোটাদাগে চারটি কারণে বাংলাদেশে বিনিয়োগের গ্রাফ নিম্নমুখী। মূলধনের অভাব, প্রাতিষ্ঠানিক দুর্বলতা, অবকাঠামোগত বাধা এবং রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা, অদক্ষ জনবল ও অস্থিতিশীল আইন-শৃঙ্খলা। মূলধনের সমস্যা সমাধানে ব্যাংক ও পুঁজিবাজারের অর্থায়নে স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা করতে হবে। প্রাতিষ্ঠানিক দুর্বলতা কমাতে ভিয়েতনামের মতো সংস্কার কর্মসূচি গ্রহণ, সরকারি সেবা ডিজিটালাইজেশন এবং মন্ত্রণালয় ও বিভিন্ন সংস্থার সংখ্যা কমিয়ে অনুমোদন প্রক্রিয়া সহজীকরণ করা দরকার। এছাড়া আমাদের বিনিয়োগ মানসিকতায় পরিবর্তন আনা দরকার। অর্থনৈতিক উন্নয়ন মানেই শুধু বৃহৎ প্রকল্প নয়। বড় আকারের অবকাঠামোগত প্রকল্প থেকে সরে এসে স্বয়ংক্রিয়করণ, পেমেন্ট অবকাঠামো ও তথ্য আদান-প্রদান প্রক্রিয়ার ডিজিটালাইজেশন এবং খাদ্য ও জ্বালানি নিরাপত্তায় বিনিয়োগ বাড়াতে হবে।’
প্রথম অধিবেশনে প্যানেল আলোচনায় যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর মুখপাত্র ড. নকিবুর রহমান বলেন, ‘রেমিট্যান্স নিয়ে আমরা নতুন করে ভাবতে পারি। দেশে আসা রেমিট্যান্স বা প্রবাসী আয়ের ৮০-৮৫ শতাংশই ভোগ্যপণ্যের পেছনে যায়। অবশিষ্ট রেমিট্যান্স ব্যয় হয় ফ্ল্যাট-বাড়ি বা জায়গা-জমি কেনাকাটায়। রেমিট্যান্সকে প্রত্যক্ষ বিদেশী বিনিয়োগ বা বন্ডে রূপান্তর করা যেতে পারে।’
এ অধিবেশনের আরেক প্যানেল আলোচক জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ড. ম. তামিম বলেন, ‘বর্তমানে আমরা তীব্র জ্বালানি সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছি। অনেক আগে থেকে আমরা কয়লা, গ্যাস ও নবায়নযোগ্য জ্বালানির কথা বলছি। কিন্তু গত ১৫ বছরে জ্বালানির উৎস কাজে লাগাতে বিনিয়োগ হয়নি। সব বিনিয়োগ হয়েছে বিদ্যুতে। এ সময়ে ৩০ বিলিয়ন ব্যয়ে বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ করা হয়েছে। বিদ্যুতে এ বিনিয়োগের কারণ হলো সেখানে দুর্নীতির সুযোগ ছিল। ফলে এখন আর কয়লা, গ্যাস ও নবায়নযোগ্য জ্বালানিতে বিনিয়োগ আসছে না। এখনো বিদ্যুৎ খাতেরও সদ্ব্যবহার হচ্ছে না। এখনো আগের মতো বিপিডিবির মাধ্যমে মন্ত্রণালয় বিদ্যুৎ নিয়ন্ত্রণ করছে। বিদ্যুতের একক ক্ষমতা কুক্ষিগত ছিল, এখনো সেটি চলছে। এখানেও অনেক সংস্কার প্রয়োজন।’
প্রথম অধিবেশনের প্যানেল আলোচনায় আরো বক্তব্য দেন বিজনেস ইনিশিয়েটিভ লিডিং ডেভেলপমেন্টের (বিল্ড) চেয়ারপারসন আবুল কাসেম খান, পলিসি এক্সচেঞ্জ বাংলাদেশের (পিইবি) চেয়ারম্যান ও সিইও ড. এম মাশরুর রিয়াজ, বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা মাহদি আমিন, এনসিপির যুগ্ম আহ্বায়ক খালেদ সাইফুল্লাহ, বাংলাদেশ পরিকল্পনা কমিশনের সাধারণ অর্থনীতি বিভাগের সদস্য মনজুর হোসেন, রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) ভাইস চেয়ারম্যান মোহাম্মদ হাসান আরিফ, হিসাববিদ স্নেহাশীষ বড়ুয়া, চালডালের সিইও ওয়াসিম আলিম, বিএনপির কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য ইসরাফিল খসরু প্রমুখ।
প্রথম অধিবেশন শুরুর আগে ‘*ম্যাক্রোইকোনমিক স্ট্যাবিলিটি অ্যান্ড ইকোনমিক রিকভারি’ নামে দুদিনব্যাপী এ সম্মেলনের মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন সামষ্টিক অর্থনীতিবিষয়ক নীতি বিশেষজ্ঞ জ্যোতি রহমান।
দিনের দ্বিতীয় অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয় ‘*ক্যাশলেস ইকোনমি অ্যান্ড ফাইন্যান্সিয়াল ইনক্লুশন’ শিরোনামে। এতে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন ‘জয়তুন বিজনেস সল্যুউশন’-এর চেয়ারপারসন মো. আরফান আলী। তিনি বলেন, ‘দেশের কর্মক্ষম জনগোষ্ঠীর সংখ্যা ১২ কোটির অধিক হলেও এর মধ্যে সাত কোটিরও বেশি লোকের ব্যাংক হিসাব নেই। আমাদের ইন্টারনেট সেবার পরিধি বাড়লেও উচ্চমূল্য এখনো বাধা হিসেবে থেকে গেছে। আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর আন্তঃলেনদেন না থাকায় আমাদের লেনদেন কঠিন ও বাধাগ্রস্ত করে ফেলেছে। এখনো দেশের ৭২ শতাংশ লেনদেন নগদ টাকায় হয়।’
এ অধিবেশনে আরফান আলীর সঙ্গে প্যানেল আলোচক ছিলেন বাংলাদেশ ব্যাংকের পেমেন্ট সিস্টেম বিভাগের অতিরিক্ত পরিচালক মোহাম্মদ রাশেদ এবং ‘টালিপে’র প্রতিষ্ঠাতা ও সিইও শাহাদাত খান।
দিনের তৃতীয় অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয় ‘*প্রোটেক্টিং মার্কেট অব কারেন্ট এক্সপোর্ট অ্যান্ড ড্রাইভিং ডাইভারসিফিকেশন’ শিরোনামে। এতে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন পিইবির চেয়ারম্যান ড. এম মাশরুর রিয়াজ। এতে প্যানেল আলোচক ছিলেন ইপিবির ভাইস চেয়ারম্যান মোহাম্মদ হাসান আরিফ, অ্যাপেক্স ফুটওয়্যারের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ নাসিম মঞ্জুর ও বাংলাদেশ অ্যাপারেল এক্সচেঞ্জ লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মহিউদ্দিন রুবেল প্রমুখ।
দিনের সর্বশেষ অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয় কৃষি খাত নিয়ে। ‘*ট্রান্সফর্মিং এগ্রিকালচার ফর আ নিউ গ্রিন রেভল্যুশন’ শীর্ষক এ অধিবেশনে প্যানেল আলোচক ছিলেন কৃষি মন্ত্রণালয়ের সাবেক সচিব আনোয়ার ফারুক, বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের বিশেষ সহকারী সাইমুম পারভেজ প্রমুখ।