অর্থনীতির তেজি অবস্থা হঠাৎ চোরাবালিতে
করোনাসৃষ্ট অর্থনৈতিক দুর্যোগে পর্যুদস্ত ছিল বিশ্ব অর্থনীতি। যদিও দুর্যোগের মধ্যেও বাংলাদেশের অর্থনীতি ছিল সমৃদ্ধির পথে। নিয়ন্ত্রিত ছিল মূল্যস্ফীতি। বড় প্রবৃদ্ধিতে ছিল রেমিট্যান্স ও বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ। করোনা পরিস্থিতির উন্নতি হলে তেজি ভাব ছিল বাংলাদেশের অর্থনীতিতে। ইতিহাসে প্রথমবারের মতো দেশের রফতানি ছাড়ায় ৫০ বিলিয়ন ডলারের মাইলফলক। কিন্তু বৈদেশিক মুদ্রা ব্যবস্থাপনায় ব্যর্থতা বাংলাদেশের অর্থনীতিকে হঠাৎ করেই চোরাবালিতে ঠেলে দিয়েছে।
গত অর্থবছরের (২০২১-২২) মে পর্যন্ত ১১ মাসেই দেশের আমদানি ব্যয় ছাড়িয়েছে ৮১ দশমিক ৪৯ বিলিয়ন ডলার। ইতিহাস সৃষ্টি করা এ আমদানি ব্যয়ের নেতিবাচক প্রভাব ছড়িয়ে পড়ছে বৈদেশিক বাণিজ্যের সবক’টি সূচকে। দিন যত যাচ্ছে দেশের অর্থনীতির মৌলিক সূচকগুলো ততই নাজুক হয়ে উঠছে। গত অর্থবছরে রেমিট্যান্স কমেছে ১৫ শতাংশেরও বেশি। গত মে পর্যন্ত অর্থবছরের ১১ মাসেই দেশের বাণিজ্য ঘাটতি ৩০ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে যায়। একই সময়ে সরকারের চলতি হিসাবের ঘাটতি ঠেকেছে ১৭ দশমিক ২৩ বিলিয়ন ডলারে। পণ্যের দাম বেড়ে মূল্যস্ফীতির হার প্রায় ৭ শতাংশে গিয়ে ঠেকেছে। চাপের মুখে পড়েছে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ। ২০২১ সালে ৪৮ বিলিয়নে উন্নীত হওয়া রিজার্ভের পরিমাণ ৩৯ বিলিয়ন ডলারে নেমেছে।
২০১৬ সালে বাংলাদেশ ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ছিল ৩০ বিলিয়ন ডলার। ওই পরিমাণ রিজার্ভ দিয়ে দেশের আমদানি সক্ষমতা ছিল প্রায় আট মাসের। প্রায় আট বিলিয়ন ডলার কমে যাওয়ার পরও বর্তমানে রিজার্ভ আছে ৩৯ বিলিয়ন ডলারেরও বেশি। কিন্তু এ পরিমাণ রিজার্ভ দিয়ে দেশের আমদানি ব্যয় মেটানো যাবে সাড়ে চার মাস। যদিও আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) হিসাবে বাংলাদেশের নিট রিজার্ভ আছে ৩১ বিলিয়ন ডলার।
এদিকে রফতানির বর্তমান প্রবৃদ্ধি নিয়ে উচ্ছ্বসিত হওয়ার সুযোগ নেই বলে মনে করছেন খাতসংশ্লিষ্টরা। তাদের ভাষ্য, বাংলাদেশে তৈরি পণ্যগুলো রফতানির প্রধান গন্তব্য পশ্চিমা দেশগুলো। কভিড-১৯ মহামারীর অভিঘাত কাটিয়ে দেশগুলোর বাজার চাঙ্গা হতে শুরু করেছিল। অনেক দিন নিষ্ক্রিয় থাকা বিক্রয়কেন্দ্রগুল সক্রিয় হওয়ার পর চাহিদার উল্লম্ফনও দেখা গিয়েছিল, যার প্রতিফলন হিসেবে মোট রফতানিতে বড় প্রবৃদ্ধি দেখতে পেয়েছে বাংলাদেশ। তবে এ প্রবৃদ্ধি টেকসই হওয়া নিয়ে অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে। কারণ নভেল করোনাভাইরাসের ওমিক্রন ভ্যারিয়েন্টের পাশাপাশি রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে পশ্চিমা বাজারগুলোর চাহিদায় ভাটার শঙ্কা সৃষ্টি হয়েছে।
বৈদেশিক মুদ্রা ব্যবস্থাপনায় ব্যর্থতার প্রভাব পড়েছে ডলারের বাজারে। বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাবেই গত এক বছরে ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়ন হয়েছে ১০ দশমিক ৭৯ শতাংশ। যদিও ডলারের বাজার পরিস্থিতি বিবেচনায় নিলে টাকার অবমূল্যায়ন হয়েছে ১৮ শতাংশেরও বেশি। গতকাল প্রতি ডলার ১০০ টাকার বেশি দরে কিনেছে দেশের মানি এক্সচেঞ্জগুলো। আর খুচরা বাজারে ডলার বিক্রি হয়েছে ১০৩ টাকায়। তবে বেশি দাম দিয়েও খুচরা বাজারে আগের মতো বড় অংকের ডলার পাওয়া যাচ্ছে না।
দেশের অর্থনৈতিক সংকটে নড়েচড়ে বসেছে সরকারও। এরই মধ্যে বিদ্যুৎ, গ্যাস, জ্বালানি তেলসহ নানা ক্ষেত্রে কৃচ্ছ্রসাধনের নীতি গ্রহণ করা হয়েছে। এরই মধ্যে বন্ধ করে দেয়া হয়েছে ডিজেলচালিত বিদ্যুৎকেন্দ্রগু ো। সংকটের কারণে গ্যাসচালিত বিদ্যুৎকেন্দ্রগু োও চাপের মুখে পড়েছে। জ্বালানিসাশ্রয়ী নীতিতে হাঁটতে গিয়ে বিদ্যুতের উৎপাদন কমিয়ে এনেছে সরকার। সারা দেশে লোডশেডিংয়ের শিডিউল করে দেয়ার মতো কঠোর নীতিও চালু করা হয়েছে।
বিদ্যুৎ, গ্যাসসহ জ্বালানি তেলের সংকটের কারণে চাপে পড়েছে দেশের শিল্প উৎপাদন। এরই মধ্যে শিল্পোদ্যোক্তারা নিজেদের উদ্বেগের কথা জানাতে শুরু করেছেন। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দেশের বৈদেশিক বাণিজ্যের ক্ষেত্রে ভুল নীতির কারণে আজকের পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। বৈদেশিক বাণিজ্যে যে অসামঞ্জস্যতা তৈরি হয়েছে, সেটি দ্রুতই কাটিয়ে ওঠার সম্ভাবনা নেই। বরং আগামীতে এ পরিস্থিতি আরো জটিল হবে।
বৈদেশিক মুদ্রার সংকট কাটাতে আইএমএফ, বিশ্বব্যাংকসহ দাতা সংস্থাগুলোর কাছ থেকে ঋণসহায়তা নেয়ার আলোচনা উঠেছে। এরই মধ্যে সরকারের বিভিন্ন সংস্থার সঙ্গে বাংলাদেশ সফররত আইএমএফ প্রতিনিধি দলের বৈঠক হয়েছে। এক্ষেত্রে আইএমএফ থেকে সাড়ে ৪ বিলিয়ন ডলার জরুরি বাজেট সহায়তা নেয়ার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে বলে জানা গেছে। ‘এসএমই খাতের উন্নয়ন ও সামাজিক সুরক্ষায়’ ব্যয় করতে এ পরিমাণ অর্থ ঋণ দিতে শিগগির আইএমএফের কান্ট্রি রিপ্রেজেন্টেটিভক আনুষ্ঠানিক চিঠি দেয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে অর্থ বিভাগ। যদিও আইএমএফের কাছ থেকে আপাতত কোনো ঋণ নেয়ার পরিকল্পনা নেই বলে জানিয়ে দিয়েছেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল।
[IMG]http://forex-bangla.com/customavatars/304577108.jpg[/IMG]