চীনের সামরিক হামলার হুমকির মধ্যেই উদীয়মান সাইবার যুদ্ধক্ষেত্রে নিজের অবস্থান শক্ত করতে সর্বাত্মক চেষ্টা চালাচ্ছে তাইওয়ান। প্রতি মাসে গড়ে দুই থেকে চার কোটি সাইবার আক্রমণের শিকার হচ্ছে তাইওয়ানের বিভিন্ন সরকারি সংস্থা ও কম্পিউটার নেটওয়ার্ক। আর এই বিপুল সংখ্যক সাইবার আক্রমণের মূল হোতা হিসেবে সন্দেহের আঙ্গুল প্রতিবেশি চীনের দিকেই। চীন বনাম তাইওয়ান বিবাদের মূলে স্বায়ত্তশাসন বিতর্ক। তাইওয়ান চীনের অংশ নাকি স্বাধীন একটি রাষ্ট্র-- প্রথম দেখায় এটি এশিয়ার স্থানীয় রাজনৈতিক বিতর্ক মনে হলেও বিশ্বায়নের বাজারে প্রযুক্তিগত অগ্রগতির জেরে বৈশ্বিক পরাশক্তিগুলোর রেষারেষির অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে এই বিতর্ক।
প্রযুক্তিগত ঝুঁকি মোকাবেলা করতে তাইওয়ান সরকার সাইবার নিরাপত্তায় আলাদা জোর দিচ্ছে বলে সম্প্রতি সিএনএনকে জানিয়েছেন দেশটির সাইবার নিরাপত্তা বিষয়ক প্রধান চিয়েন হুং-ওয়েই। প্রতি মাসে দেশটির বিভিন্ন সরকারি কম্পিউটার সিস্টেমে সাইবার আক্রমণ হচ্ছে সেটি মোকাবেলা করতে প্রায় দুই ডজন কম্পিউটার বিশেষজ্ঞ নিয়োগ দেওয়া হয়েছে বলে জানান তিনি। তবে ওই বিপুল সংখ্যক সাইবার আক্রমণের বেশিরভাগ সফলভাবে প্রতিহত করার দাবিও করেছে তাইওয়ান। তবে এই ব্যাপক সাইবার আক্রমণের পেছনে মূল হোতা হিসেবে তাইওয়ানের নজর চীনের দিকে। “আক্রমণকারীদের কাজ এবং কাজের ধরনের উপর ভিত্তি করে আমরা বেশ আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে বলতে পারি যে, আক্রমণগুলো আমাদের প্রতিবেশিদের কাছ থেকেই আসছে”, চীনকে ইঙ্গিত করে বলেন হুং-ওয়েই। “আমাদের সরকারি কাজকর্ম ইন্টারনেট সংযোগের উপর অনেক বেশি নির্ভরশীল। গ্যাস, পানি ও বিদ্যুতের মতো আমাদের জরুরী অবকাঠামোগুলো ডিজিটাল প্রযুক্তি নির্ভর, তাই নেটওয়ার্ক নিরাপত্তা ব্যবস্থা যথেষ্ট শক্ত না হলে আমাদের ভূক্তভোগী হওয়ার ঝুঁকি অনেক বেশি।”বিশ্বের প্রায় সব দেশ ও শিল্পখাতের জন্য মাথা ব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে সাইবার আক্রমণের হুমকি। বড় পরিসরে সাইবার আক্রমণের অভিযোগ কেবল চীনের বিপরীতেই আছে, বিষয়টি এমনও নয়। তবে সাম্প্রতিক সময়ে সাইবার নিরাপত্তা বিষয়ে পশ্চিমা দেশগুলোর ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়েছে চীন।
মার্চ মাসে ম্যালওয়্যার আক্রমণের শিকার হয়েছিলো মাইক্রোসফটের এক্সচেঞ্জ ইমেইল সেবা। ওই ঘটনাসহ সাম্প্রতিক বেশ কয়েকটি সাইবার আক্রমণের ঘটনায় চীনের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সমর্থিত হ্যাকারদের সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ তুলে বেইজিং সরকারের কড়া সমালোচনা করেছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপিয়ার ইউনিয়ন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের একযোগে চীনের কড়া সমালোচনা, সাইবার নিরাপত্তা ইস্যুতে বাইডেন সরকার যে শক্ত অবস্থান নিচ্ছে, তারই ইঙ্গিত বলে জানিয়েছে সিএনএন। সম্প্রতি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের খাদ্য ও জ্বালানী শক্তি উৎপাদন খাতের সাইবার দুর্বলতা চিহ্নিত হওয়ার ফল হিসেবেই বিবেচনা করা হচ্ছে পশ্চিমা দেশগুলোর বর্তমান অবস্থান।
[IMG]http://forex-bangla.com/customavatars/1989978216.jpg[/IMG]
সাইবার দুনিয়াতে হবে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ!
বৈশ্বিক রাজনৈতিক অস্থিরতার আগুনে নতুন করে ঘি ঢালছে রাষ্ট্রীয় অবকাঠামোর উপর সাইবার আক্রমণের ঘটনা। এই পরিস্থিতি মোকাবেলায় তৎপর হচ্ছে বৈশ্বিক পরাশক্তিগুলো। সম্প্রতি সাইবার আক্রমণের ঘটনায় বিকল হয়ে গিয়েছিলো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ তেলের পাইপলাইনগুলোর একটি। পৃথক আরেক সাইবার আক্রমণে বন্ধ হয়ে গিয়েছিলো মাংস প্রক্রিয়াজাতকরণে দেশটির বৃহত্তম প্রতিষ্ঠানগুলোর একটি ‘জেবিএস ইউএসএ’-র সরবরাহ ব্যবস্থা। এপ্রিল মাসে ২০২০ সালকে মুক্তিপণের দাবিতে সাইবার আক্রমণের হিসেবে সবচেয়ে খারাপ বছর বলে আখ্যা দেয় যুক্তরাষ্ট্রের বিচার বিভাগ। আর সাইবার সিকিউরিটি প্রতিষ্ঠান ‘চেক পয়েন্ট সফটওয়্যার’-এর তথ্য অনুযায়ী, ২০২০ সালের প্রথম ছয় মাসের তুলনায় ২০২১ সালের প্রথম ছয় মাসে র*্যানসমওয়্যার আক্রমণের ঘটনা বেড়েছে ১০২ শতাংশ। সাইবার জগতে তৎপর হ্যাকারদের দুই ভাগে ভাগ করা যেতে পারে বলে সিএনএনকে জানিয়েছেন তাইওয়ানের সাইবার নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠান ‘ডেভকোর’-এর প্রধান নির্বাহী অ্যালেন ওউন। তার মতে কিছু হ্যাকার কাজ করছে ব্যক্তিগত মুনাফার জন্য, আর কিছু হ্যাকার কাজ করছে রাস্ট্রীয় স্বার্থ রক্ষায়।
ওইনের তথ্য অনুযায়ী, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, চীন, রাশিয়া ও উত্তর কোরিয়ার মতো দেশগুলো ইতোমধ্যেই নিজস্ব সাইবার আর্মি তৈরি করে ফেলেছে। এদের মূল দায়িত্ব হচ্ছে গোপন তথ্য সংগ্রহ করা, অন্য দেশের প্রযুক্তি অবকাঠামোতে অনুপ্রবেশ, এবং নিজের দেশ সাইবার আক্রমণের শিকার হলে সেটি প্রতিহত করা। এই পরিস্থিতির কারণেই তাইওয়ানের নিজস্ব সাইবার নিরাপত্তা ব্যবস্থা আরও জোরদার করা প্রয়োজন বলে মন্তব্য করেন তিনি। “তথ্য প্রযুক্তি খাতের অনেকের মত, তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ হবে ইন্টারনেটে”, এমনটাই বলেন ওউন।
তাইওয়ান এই পরিস্থিতি মোকাবেলায় আগেই থেকেই প্রস্তুতি নিচ্ছে বলে জানিয়েছে সিএনএন। ২০১৬ সালে সাইবার নিরাপত্তা ঝুঁকি মোকাবেলা করতে সাইবার নিরাপত্তা বিভাগ প্রতিষ্ঠা করে দেশটির সরকার। ওই সময় সাইবার নিরাপত্তা রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার অংশ বলে ঘোষণা করেন দেশটির রাষ্ট্রপতি আই এং-হোয়েন। দেশের গুরুত্বপূর্ণ অবকাঠামোগুলোর সাইবার নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে আলাদা মন্ত্রণালয় দাঁড় করানোর ঘোষণা দেন তিনি। অন্যদিকে, চীন সামরিক হুমকি, ভুয়া তথ্য প্রচার এবং সাইবার আক্রমণের মাধ্যমে তাইওয়ান সরকারের উপর নাগরিক আস্থা দুর্বল করার অপচেষ্টা চালাচ্ছে বলে অভিযোগ করেন তাইওয়ানের পররাষ্ট্র মন্ত্রী জোসেফ উ।
“তারা তাইওয়ানের নাগরিকদের মধ্যে এমন ধারণা তৈনি করতে চাইছে যে, তাইওয়ানের সরকার নাগরিকদের জন্য বিপজ্জনক এবং চীনকে ছাড়া চলবেই না আমাদের। কিন্তু অনেক দিন ধরে চীনের সাইবার আগ্রাসন মোকাবেলা করতে করতে সাইবার হামলা ঠেকানোর যথেষ্ট অভিজ্ঞতাও অর্জন করেছি আমরা। ”, সিএনএনকে জানান তিনি।
অন্যদিকে তাইওয়ানের সাইবার নিরাপত্তা বিভাগের প্রধান হুং-ওয়েই জানিয়েছেন, টানা কয়েক বছর ধরে প্রতি মাসে তাইওয়ানের উপর সাইবার আক্রমণের ঘটনা থাকে কোটির ঘরে। তবে এর সিংহভাগ ভেস্তে দিয়েছে দেশটির নিজস্ব সাইবার নিরাপত্তা ব্যবস্থা। ২০২০ সালে দেশটির উপর সফল সাইবার আক্রমণের ঘটনা ১০টির মতো ছিলো বলে দাবি করেন তিনি। বিস্তারিত জানাতে অস্বীকার করলেও তাইওয়ানের শিক্ষা ব্যবস্থার কেন্দ্রিয় কম্পিউটার সিস্টেমে হ্যাকিংয়ের ফলে শিক্ষার্থীদের তথ্য বেহাত হওয়ার ঘটনা স্বীকার করেন তিনি।
অন্যদিকে তাইওয়ানের আরেক সাইবার নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞ সাই সুং-টিং এর মতে, প্রাথমিক সাইবার আক্রমণ মোকাবেলা করলেও ডেটা বেহাত হওয়ার ফলে পরবর্তী আক্রমণের ঝুঁকি থেকেই যায়।
“আমরা এটা খেয়াল করেছি যে, কোনো প্রতিষ্ঠানের কম্পিউটার সিস্টেম আক্রমণের শিকার হলে সবার আগে চুরি হয় ইমেইল ও অন্যান্য গুরুত্তপূর্ণ ফাইল। প্রাথমিক আক্রমণ করতে পারলেও, কখনো পরের মাসে, কখনো বা কয়েক মাস পরে প্রথমবার আক্রমণ করে পাওয়া ডেটা কাজে লাগিয়ে আক্রমণ করে হ্যাকাররা। তাই ঝুঁকিটা থেকেই যায়”, বলেন দেশটির সাইবার নিরাপত্তাবিষয়ক প্রতিষ্ঠান ‘টিম টিফাইভ’-এর ওই প্রধান নির্বাহী।