সীমাহীন অনিয়ম-দুর্নীতির কারণে দেশের অর্ধেকের বেশি ব্যাংকই এখন রুগ্*ণ। লুণ্ঠনের শিকার দেশের এক ডজন ব্যাংক এখন গ্রাহকদের আমানত ফেরত দিতেও ব্যর্থ হচ্ছে। এ পরিস্থিতিতে ব্যাংক খাতকে আরো স্বচ্ছ ও জবাবদিহির আওতায় এনে ঝুঁকি কমাতে নতুন সুপারভিশন পদ্ধতি চালুর ঘোষণা দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এ প্রক্রিয়ার দক্ষতা বৃদ্ধি ও কার্যকর পর্যবেক্ষণ নিশ্চিত করতে রিস্ক বেজড সুপারভিশন (আরবিএস) পদ্ধতি প্রবর্তনের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে।
গতকাল বাংলাদেশ ব্যাংকে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে গভর্নর আহসান এইচ মনসুর এ ঘোষণা দেন। গভর্নর বলেন, ‘*নতুন আরবিএস পদ্ধতিতে ব্যাংকগুলো নির্দিষ্ট ফরম্যাটে কেন্দ্রীয় ব্যাংকে নিয়মিত প্রতিবেদন জমা দেবে। এসব প্রতিবেদনের ভিত্তিতে আগে থেকেই ব্যাংকগুলোর সম্ভাব্য ঝুঁকি মূল্যায়ন করবে। এক্ষেত্রে সব ব্যাংকের ঝুঁকি একই রকম নাও হতে পারে।’
নতুন পদ্ধতিকে ৩৬০ ডিগ্রি সুপারভিশন পদ্ধতি নামে আখ্যা দিয়েছেন গভর্নর। তিনি বলেন, ‘*এ ফ্রেমওয়ার্কে দেশের ৬১টি ব্যাংককে ১২টি ভাগে ভাগ করা হবে। প্রতিটি ভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত পর্যবেক্ষকরা নিয়মিত ব্যাংকগুলোর ওপর নজরদারি করবেন। তাদের কাছে দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যাংকগুলোর সব তথ্য থাকবে। এখানে অফসাইড বা অনসাইড সুপারভিশন বলে কিছু থাকবে না। তারা ব্যাংকের পুরো পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করে সম্ভাব্য ঝুঁকি মূল্যায়ন করবেন।’
এ পদ্ধতিতে ব্যাংকের অন্তত ৮০-৯০ ভাগ ঝুঁকি সম্পর্কে আগে থেকেই পদক্ষেপ নেয়া সম্ভব হবে বলে মনে করেন আহসান এইচ মনসুর। তিনি বলেন, ‘*নিয়মিতই নতুন ঝুঁকি আসবে। সব ঝুঁকিই হয়তো আগে থেকে অনুমান করা সম্ভব নয়। তবে ব্যাংকগুলোকে এসব ঝুঁকি মোকাবেলা করার সক্ষমতা রাখতে হবে। যতটুকু সম্ভব আগে থেকেই অনুমান করার চেষ্টা করতে হবে।’
স্বাধীনতার পর ২০০৯ সাল পর্যন্ত পুরনো সুপারভিশন কাঠামোতেই চলছিল দেশের ব্যাংক খাত। এ সময় পর্যন্ত বড় ধরনের অনিয়ম দেখা যায়নি এ খাতে। নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মাধ্যমে আওয়ামী লীগের ক্ষমতা গ্রহণের পরই আর্থিক খাতের বড় বড় কেলেঙ্কারি ঘটতে থাকে। বিশেষ করে ২০১৪ সালে টানা দ্বিতীয়বার আওয়ামী লীগের ক্ষমতা গ্রহণের পর জোরপূর্বক মালিকানা স্থানান্তর করে কিছু ব্যাংকে লুণ্ঠন চালানো হয়। একই সঙ্গে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকসহ পুরো ব্যাংক খাতেই জেঁকে বসে সীমাহীন অনিয়ম-দুর্নীতি। এর প্রভাবে বাড়তে থাকে খেলাপি ঋণের পরিমাণ।
রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়েই বিগত সময়ে দেশের ব্যাংক খাতে লুণ্ঠন হয়েছে। এ অবস্থায় নতুন সুপারভিশন পদ্ধতি কতটা কার্যকর হবে—সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নে আহসান এইচ মনসুর বলেন, রাজনীতির গুণগত পরিবর্তন না হলে তদারকি ব্যবস্থাও ব্যাংকের ঝুঁকি কমাতে পারবে না। রাজনৈতিক ঝুঁকি কমাতে হলে রাজনীতিকে পরিশুদ্ধ হতে হবে। একই সঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংককে পূর্ণ স্বায়ত্তশাসন দিতে হবে। যে রাজনৈতিক দল ব্যাংক খাতকে দুর্বল করে গেছে, তাদের পরিণতি সবাই দেখেছে। বিশৃঙ্খলা তৈরি করে সাময়িক উপকার মিললেও রাজনৈতিক দলের জন্য শেষ বিচারে তা ভালো হয় না।
মোটাদাগে পাঁচটি বিষয়ের ওপর গুরুত্ব দেয়া হয়েছে আরবিএস পদ্ধতিতে। এগুলো হলো আরবিএস ফ্রেমওয়ার্ক প্রবর্তন, সাংগঠনিক পুনর্গঠন, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ঊর্ধ্বতন ব্যবস্থাপনায় দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য প্রশিক্ষণ কর্মসূচি প্রণয়ন, র*্যাশনালাইজড ইনপুট টেমপ্লেট (আরআইটি) বা তথ্যভিত্তিক পর্যবেক্ষণ বাস্তবায়ন ও ঝুঁকি মূল্যায়ন, পরিকল্পনা, পর্যবেক্ষণ অন্তর্ভুক্তকরণ ইত্যাদির চক্রাকার তত্ত্বাবধায়ন প্রক্রিয়া।
আরবিএস বাস্তবায়ন নিশ্চিত করতে বাংলাদেশ ব্যাংকের ঊর্ধ্বতন ব্যবস্থাপনা কর্মকর্তা, সংশ্লিষ্ট নির্বাহী পরিচালক ও পরিচালকদের সঙ্গে এরই মধ্যে সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে। একই সঙ্গে তফসিলি ব্যাংকগুলোর প্রধান নির্বাহীদের সঙ্গেও বিষয়টি আলোচনা করা হয়েছে বলে জানান গভর্নর। তিনি বলেন, ‘আরবিএস বাস্তবায়নে ইতিমধ্যে ২০টি ব্যাংকের সঙ্গে আমাদের পরীক্ষামূলক কার্যক্রম শেষ হয়েছে। আগামী ছয় মাসের মধ্যেই বাকি ব্যাংকগুলোও এ পদ্ধতির আওতায় চলে আসবে। এ উদ্যোগ দেশের আর্থিক খাতের স্থিতিশীলতা সুসংহত করবে এবং দীর্ঘমেয়াদে টেকসই অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিকে সহায়তা করবে।’
২০২৮ সালের জানুয়ারি থেকেই ইন্টারন্যাশনাল ফাইন্যান্সিয়াল রিপোর্টিং স্ট্যান্ডার্ড-৯ (আইএফআরএস-৯) অনুসরণ করা হবে বলে জানান গভর্নর। তিনি বলেন, ‘আশপাশের দেশ অনেক আগেই আইএফআরএস-৯ অনুসরণ করা শুরু করেছে। আমরা ২০২৮ সালের জানুয়ারি থেকেই আইএফআরএস-৯-এর মান অনুসরণ করার চেষ্টা করছি। যদিও এ যাত্রাটা আমাদের জন্য সহজ নয়, বরং উচ্চাভিলাষী। পৃথিবীর বেশির ভাগ দেশই চার বছরের আগে আইএফআরএস-৯-এ যেতে পারেনি। আমরা দুই বছরের মধ্যে সেখানে যাওয়ার চেষ্টা করছি।’
বেশ কয়েক দিন ধরেই ছয়টি দুর্বল ব্যাংককে একীভূত করার কথা বলে আসছেন গভর্নর। যদিও কয়েকটি ব্যাংক এ প্রক্রিয়ায় যেতে অনীহা প্রকাশ করছে। এ বিষয়ে ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, দুর্বল ছয়টি ব্যাংকের সম্পদের মান পর্যালোচনা করে পাঁচটি ব্যাংককে একীভূত করার বিষয়ে আলোচনা হয়েছে। চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয়ার আগে তাদের প্রত্যেকের সঙ্গে আলাদাভাবে আলোচনা করা হবে। কোনো ব্যাংক যদি একীভূত না হওয়ার ব্যাপারে যৌক্তিক কারণ দেখাতে পারে, তাহলে তাদের বিষয়টি পর্যালোচনা করা হবে।
ব্যাংকের ৫০ শতাংশ পরিচালক স্বতন্ত্র হতে হবে জানিয়ে গভর্নর বলেন, ব্যাংকের স্বতন্ত্র ও শেয়ারধারী উভয় পরিচালককে যোগ্যতাসম্পন্ন হতে হবে। স্বতন্ত্র পরিচালক নিয়োগ দিতে হবে বাংলাদেশ ব্যাংকের তৈরি করা প্যানেল থেকে। কারা স্বতন্ত্র পরিচালক হতে পারেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংক তার একটা তালিকা করবে। তালিকার বাইরে কাউকে স্বতন্ত্র পরিচালক করতে চাইলে তাকেও যোগ্যতাসম্পন্ন হতে হবে। যোগ্যতা ছাড়া কাউকে স্বতন্ত্র পরিচালক করা যাবে না। আর পর্ষদ পরিবর্তন করা ব্যাংকগুলোর কার্যক্রমও মূল্যায়ন করা হচ্ছে। প্রয়োজনে সেখানে আরো পরিবর্তন করা হতে পারে।
ব্যাংকগুলোয় ছোট আমানতকারীদের অর্থ ফেরত দেয়ার জন্যই তারল্য সহায়তা দেয়া হয়েছে জানিয়ে গভর্নর বলেন, সব আমানতকারীর অর্থ সুরক্ষিত আছে। যেসব আর্থিক প্রতিষ্ঠান গ্রাহকের টাকা ফেরত দিতে পারছে না, তাদের কেন বন্ধ করা হবে না, তা জানতে চেয়ে নোটিস পাঠানো হয়েছে। সব আর্থিক প্রতিষ্ঠান টিকে থাকতে পারবে না।