ফরেক্স ট্রেডিং করে কি ধনী হওয়া যায়? যদিও প্রাথমিকভাবে আমাদের সহজাত উত্তর হবে একটি সম্মিলিত “না,” তবু আমাদের বিষয়টা খতিয়ে দেখা উচিত।
ফরেক্স ট্রেডিং করে একজন ধনী হেজ ফান্ড ম্যানেজার অথবা কারেন্সি ট্রেডিং-এ খুব দক্ষ কেউ সম্পদের পাহাড় গড়তে পারবে। কিন্তু একজন সাধারণ রিটেইল ট্রেডারের জন্য ফরেক্স ট্রেডিং রাতারাতি বড়লোক হবার পথ নয় বরং বিরাট লোকসান এবং পথে বসার রাস্তা হতে পারে।
প্রথমেই পরিসংখ্যান দেখা যাক। ২০১৪-এর নভেম্বরের একটি ব্লুমবার্গ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে যে তাদের গ্রাহকদের কাছে সমকালীন দুটো বৃহত্তম ফরেক্স কোম্পানি—গেইন ক্যাপিটাল হোল্ডিং (gcap) ইনকর্পোরেটেড আর fxcm ইনকর্পোরেটেড—এর করা রিপোর্ট অনুযায়ী আগের বছর মুদ্রা বিনিময় করে ৬৮% বিনিয়োগকারী নেট লোকসান করেছে।
এই রিপোর্ট থেকে মনে হতে পারে যে গড়ে প্রায় তিনজন ট্রেডারে একজন মুদ্রা বিনিময় করে টাকা হারায় না, কিন্তু সেটা আর ফরেক্স ট্রেডিং করে ধনী হওয়া এক কথা না।
লক্ষ করুন, ব্লুমবার্গের এই প্রতিবেদনটি মুদ্রা বাজারে আকস্মিক ঘটে যাওয়া একটা বড় বিপর্যয়ের যা ফরেক্স ট্রেডিং-এর ঝুঁকিগুলোকে দৃষ্টিগোচর করেছে। ২০১৫-এর ১৫ই জানুয়ারি সুইস ন্যাশনাল ব্যাঙ্ক তিন বছর ধরে ইউরোর বিপরীতে সুইস ফ্র্যাঙ্কের যে ১.২০ মান ছিল তা পরিত্যাগ করে। ফলস্বরূপ সুইস ফ্র্যাঙ্ক রাতারাতি ওইদিনই ইউরোর বিপরীতে ৪১% এবং মার্কিন ডলারের বিপরীতে ৩৮% উঠে যায়।
সুইজারল্যান্ডের সেন্ট্রাল ব্যাঙ্কের এই আকস্মিক সিদ্ধান্তের কারণে ফরেক্স ট্রেডিং-এর অগণিত ব্যবসায়ীর শত শত মিলিয়ন ডলার লোকসান হয়। ছোটছোট খুচরা ব্যবসায়ী থেকে শুরু করে বড় বড় ব্যাঙ্ক—সবাই এতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। রিটেইল ট্রেডিং একাউন্টের লোকসানের ফলে কমপক্ষে তিনটি ব্রোকারেজের মূলধন বিলীন হয়ে গিয়ে তাদেরকে অসচ্ছল করে দেয়। এবং তৎকালীন আমেরিকার সবচেয়ে বড় রিটেইল ফরেক্স ব্রোকারেজ fxcm-কে দেউলিয়া হবার দ্বারপ্রান্তে নিয়ে যায়।
আকস্মিক এককালীন ঘটনাই ফরেক্স ট্রেডারদের একমাত্র ঝুঁকি নয়। নিচে আরো সাতটি কারণ দেখানো হলো যা কিনা রিটেইল ট্রেডারদের ফরেক্স মার্কেটে ট্রেডিং করে ধনী হবার পথে অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায়।
অতিরিক্ত লেভারেজ
যদিও মুদ্রার অস্থিতিশীলতা থাকতে পারে, কিন্তু ওপরে বর্ণিত সুইস ফ্র্যাঙ্কের কারণে সৃষ্ট ভয়াবহ বিপর্যয়ের মতো ঘটনা কমই ঘটে থাকে। উদাহরণস্বরূপ, এক সপ্তাহের মধ্যে মার্কিন ডলারের বিপরীতে ইউরোর মান ১.২০ থেকে ১.১০ চলে যাবার মতো বড় পরিবর্তনও বাস্তবিক ১০% এর চেয়েও কম। অন্যদিকে স্টক একদিনে সহজেই ২০% ওঠানামা করতে পারে। কিন্তু ফরেক্স ট্রেডিং-এর প্রলোভনটা আসলে রয়েছে বিশাল লেভারেজ-এর মাঝে যা ফরেক্স ব্রোকারেজরা দিয়ে থাকে। লেভারেজ মুনাফা এবং লোকসানকে বৃদ্ধি করতে পারে।
একজন ট্রেডার যদি ৫০০০ ডলার সমপরিমাণ ইউরো মার্কিন ডলারের বিপরীতে ১.২০ মান-এ শর্ট করে এবং শর্ট পজিশনটা ১.১০ মান-এ কভার করে তাহলে সে ৮.৩৩%-এ ৫০০ ডলার মুনাফা করবে। ট্রেডার যদি আমেরিকায় বৈধ সর্বোচ্চ লেভারেজ ব্যবহার করে (৫০:১) তাহলে ট্রেডিং-এর খরচ এবং কমিশন হিসাব না করলে সে ২৫,০০০ ডলার মুনাফা করবে, ৪১৬.৬৭%।
অবশ্যই, ট্রেডার যদি ইউরো ১.২০ মান-এ লং করত এবং ৫০:১ লেভারেজ ব্যবহার করত আর ট্রেড থেকে ১.১০ মান-এ বেরিয়ে আসত তাহলে সে ২৫,০০০ ডলার লোকসান করতে পারত। কোন কোন দেশে লেভারেজ এমনকি ২০০:১ বা আরো বেশিও হতে পারে। এ কারণেই অতিরিক্ত লেভারেজ হচ্ছে রিটেইল ফরেক্স ট্রেডিং-এর সবচেয়ে বড় ঝুঁকি। অনেক দেশের নিয়ন্ত্রকরাই এটার দিকে নজর দিচ্ছে।
ঝুঁকি এবং পুরস্কারের অসামঞ্জস্যতা
অভিজ্ঞ ফরেক্স ট্রেডাররা তাদের লোকসান সীমিত রাখে এবং কারেন্সি কল সঠিক হলে মোটা অংকের মুনাফা করে। বেশিরভাগ খুচরা ট্রেডাররা অবশ্য উলটো পথে যায়। অনেকগুলো ট্রেডে তারা অল্প অল্প লাভ করে কিন্তু পরে একটা বাজে ট্রেডে বড় লোকসান করে সব খোয়ায়। এমনকি নিজেদের প্রাথমিক মূলধনও।
প্লাটফর্ম অথবা সিস্টেমের ত্রুটি
একবার ভাবুন, বড় অংকের মুনাফা করার পর আপনি যদি প্লাটফর্ম অথবা সিস্টেমের সমস্যার জন্য ট্রেডটা ক্লোজ করতে না পারেন, কেমন লাগবে? এমনটা হতে পারে পাওয়ার ফেইলিওর, ইন্টারনেটের সমস্যা বা কম্পিউটার ক্র্যাশ।
এই তালিকাতে আরো থাকবে সেইসব ভয়াবহ অস্থিতিশীল সময়গুলো যখন স্টপ-লস কাজ করে না। যেমন ১৫ই জানুয়ারি, ২০১৫-তে ঘটা কারেন্সি সার্জের আগে অনেক ট্রেডারই সুইস ফ্র্যাঙ্কের শর্টের ওপর শক্ত স্টপ-লস আরোপ করে রেখেছিল। কিন্তু তাতে রক্ষা হয়নি কারণ লিকুইডিটি কমে গিয়েছিল, তাড়াহুড়া করেও কেউ তাদের ফ্র্যাঙ্কের শর্ট পজিশন বাঁচাতে পারেনি।
বাড়তি তথ্যগত সুবিধা
বড় ফরেক্স ট্রেডিং ব্যাঙ্কগুলো কারেন্সি জগতে বিরাট সব ট্রেডিং অপারেশন চালিয়ে থাকে। এরফলে এরা অনেক তথ্যগত সুবিধা পায় (যেমন কমার্শিয়াল ফরেক্স-এর খবর বা গোপন সরকারি তৎপরতার বার্তা) যা রিটেইল ট্রেডারদের নাগালের বাইরে।
মুদ্রার অস্থিতিশীলতা
সুইস ফ্র্যাঙ্কের উদাহরণটা থেকে দেখা যায় যে উঁচু লেভারেজ থাকলে অস্বাভাবিক মুদ্রা অস্থিতিশীলতার সময় ট্রেডিং ক্যাপিটাল খুব দ্রুত নিঃশেষিত হয়ে যেতে পারে। এই বিষয়গুলো হুট করে ঘটে এবং বেশিরভাগ ট্রেডার কোন প্রতিকার ব্যবস্থা নেয়ার আগেই মার্কেট ওলটপালট করে দেয়।
otc মার্কেট
ফরেক্স মার্কেট হচ্ছে একটি ওভার-দ্য-কাউন্টার (otc) মার্কেট যা স্টক বা ফিউচারস মার্কেটের মতো সেন্ট্রালাইজড এবং নিয়ন্ত্রিত নয়। এর মানে আরো দাঁড়ায় যে ফরেক্স ট্রেডগুলো কোন ধরনের ক্লিয়ারিং অর্গানাইজেশনের দ্বারা গ্যারান্টিড না। ফলস্বরূপ কাউন্টার পার্টি রিস্ক সৃষ্টি হয়।
প্রতারণা এবং মার্কেটে কারসাজি
ফরেক্স মার্কেটে মাঝে মাঝে প্রতারণার ঘটনা ঘটে থাকে। যেমন সিকিউর ইনভেস্টমেন্ট-এর ঘটনা, ২০১৪-তে বিনিয়োগকারীদের এক বিলিয়ন ডলারেরও বেশি মূলধন নিয়ে তারা লাপাত্তা হয়ে গিয়েছিল। মার্কেটে কারসাজি করে ফরেক্স রেট পরিবর্তনের ঘটনাও অপ্রতুল নয় এবং এর সঙ্গে ফরেক্স বাজারের রাঘব বোয়ালেরা জড়িত।
যেমন ২০১৫ সনের মে মাসে, চারটা বড় ব্যাঙ্ককে ২০০৭ আর ২০১৩ সনে মুদ্রা বিনিময়ের হার পরিবর্তনের প্রচেষ্টার জন্য প্রায় ৬ বিলিয়ন ডলার জরিমানা করা হয়েছিল। ওই কেলেঙ্কারিতে আগে পরে মিলিয়ে সাতটা ব্যাঙ্কে সর্বমোট দশ বিলিয়ন ডলারেরও বেশি জরিমানা করা হয়।
পরিশিষ্ট
আপনি যদি এরপরও ফরেক্স ট্রেডিং করতে চান তাহলে কিছু নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা নেয়া বুদ্ধিমানের কাজ হবে। লেভারেজ সীমিত রাখুন, টাইট স্টপ-লস ব্যবহার করুন, এবং একটি স্বনামধন্য ফরেক্স ব্রোকারেজকে বেছে নিন। এতসব করলেও আপনার লোকসানের সম্ভাবনাই বেশি, তবু এই সতর্কতাগুলো অবলম্বন করলে আপনার কিছুটা হলেও লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড পাওয়ার আশা থাকবে ।