মার্কিন মিডিয়া ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল বলছে ডলারের পরিবর্তে চীনের কাছে সৌদি আরব তেল বিক্রির বিষয়টি সক্রিয়ভাবে চিন্তা করছে। এনিয়ে রিয়াদ ও বেইজিংয়ের মধ্যে কার্যকর আলোচনা চলছে। অর্ধশতাব্দী ধরে বিশে মার্কিন ডলার যে একচেটিয়া প্রভাব ফেলে আসছে বিশ অর্থব্যবস্থায় এতে বড় এক নিয়ন্ত্রণ আসতে যাচ্ছে বলেই মনে করছে ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল। এরফলে আন্তর্জাতিক মুদ্রা মজুদ ঝুঁকিতে পড়তে পারে। একই সঙ্গে রাশিয়া টুডের প্রতিবেদন বলছে, এমন পদক্ষেপ অর্ধশতাব্দী ধরে আর্থিক ক্ষেত্রে রাজত্ব করে আসা পেট্রোডলারের একক আধিপত্যকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে। এমনকি আন্তর্জাতিক রিজার্ভ মুদ্রা হিসেবে ডলারের গ্রহণযোগ্যতা ঝুঁকিতে ফেলবে।
[ATTACH=CONFIG]17064[/ATTACH]
সৌদি আরব ১৯৭৪ সাল থেকে ডলারে তেল বিক্রি করে আসছে। ওয়াশিংটনের পক্ষ থেকে সে সময় পেট্রোডলার ব্যবস্থাপনায় প্রতি আনুগত্যের বিনিময়ে সৌদি আরবের নিরাপত্তার নিশ্চয়তা দেয়া হয় সৌদি আরবের মোট রপ্তানি করা তেলের এক-চতুর্থাংশের ক্রেতা চীন। এখন যদি ডলারের বিপরীতে ইউয়ানে লেনদেন শুরু হয় তাহলে আন্তর্জাতিক বাজারে চীনের মুদ্রার প্রভাব বৃদ্ধি পাবে। বর্তমানে তেল বেচাকেনার প্রায় ৮০ শতাংশ ক্ষেত্রে ডলার ব্যবহার হয়। চীন ও সৌদি আরব ছয় বছর ধরে ইউয়ানে তেলের মূল্য নির্ধারণের বিষয়ে আলোচনা করে আসছে। সম্প্রতি মার্কিন সরকারের কিছু নীতির বিষয়ে সৌদি আরব অসন্তুষ্ট ও ক্ষুব্ধ। বিশেষ করে ইয়েমেন যুদ্ধের বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্র দীর্ঘদিনের মিত্র সৌদি আরবের সঙ্গে দূরত্ব বজায় রাখার বিষয়টি ভালো চোখে দেখেনি সৌদি শাসকগোষ্ঠী। সৌদি সরকার মনে করছে ইয়েমেনে তারা যে আগ্রাসন চালাচ্ছে তাতে দেওয়া সমর্থন থেকে যুক্তরাষ্ট্র অনেকটাই দূরে সরে গেছে। এ ছাড়া দূতাবাসে সৌদি সাংবাদিক জামাল খাশোগজি হত্যার সঙ্গে কার্যত সৌদি শাসক ক্রাউন প্রিন্স মোহাম্মদ বিন সালমানকে জড়িয়ে ফেলা এবং অনেক ক্ষেত্রে নিরাপত্তা প্রতিশ্রুতির লঙ্ঘন করায় যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি বিরক্ত সৌদি আরব। সম্প্রতি প্রেসিডেন্ট বাইডেনের ফোনকলে সাড়া দেননি সৌদি ক্রাউন প্রিন্স বিন সালমান। প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ২০২০-এ নির্বাচনী প্রচারণার সময় সৌদি প্রিন্সের ব্যাপক সমালোচনা করেন। তিনি সে সময় বলেন, সালমান শুধু মানবাধিকারই লঙ্ঘন করেননি তিনি তার অনুভূতিকেও আহত করেছেন। বাইডেনের এই ধরনের কর্মকা- বিন সালমান যে ভালোভাবে নেননি সম্প্রতি তার প্রমাণ মিলেছে। ইউক্রেন যুদ্ধ নিয়ে রাশিয়ার সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সাম্প্রতিক দ্বন্দ্বে এরই মধ্যে রাশিয়া থেকে জ্বালানি আমদানি নিষিদ্ধ করেছে যুক্তরাষ্ট্র। ফলে সস্তায় জ্বালানি পেতে আলোচনা করতে সৌদি আরবের কার্যত শাসক ক্রাউন প্রিন্স সালমানকে ফোন দিয়েছিলেন বাইডেন। কিন্তু তার আগেই তেল নিয়ে রুশ প্রেসিডেন্ট পুতিন বিন সালমানের সঙ্গে কথা বলে রেখেছিলেন। যুক্তরাষ্ট্রে তেলের দাম সাম্প্রতিক সময়ে সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌছেছিল। সৌদি আরব যদি চীনের কাছে ডলারের পরিবর্তে ইউয়ানে তেল বেচা শুরু করে তবে তা রাশিয়া, অ্যাঙ্গোলা ও ইরাকের মতো দেশও অনুসরণ করতে পারে। কারণ রাশিয়া এরই মধ্যে ইউক্রেন ইস্যুতে ব্যাপক নিষেধাজ্ঞা ও অবরোধের মধ্যে আছে। ডলার ব্যবহারের ক্ষেত্রেও দেশটির ওপর বিধিনিষেধ রয়েছে। ইউয়ান হতে পারে রাশিয়ার জন্য একটি বড় সুযোগ। যদিও সৌদি আরবের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করতে দেশটি সফরের পরিকল্পনা করছেন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। কিন্তু ৮১ জনকে এক দিনে মৃত্যুদ- দেয়ার ঘটনায় মানবাধিকারের প্রতি সৌদি আরবের দায়বদ্ধতা নিয়ে এরই মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রে বিতর্ক শুরু হয়ে গেছে। ইরান, ইরাক, সিরিয়া ও লিবিয়া ডলার থেকে নিজেদের সরিয়ে নিয়েছে। এদিকে আফগানিস্তানে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক ব্যর্থতা ও সাম্প্রতিক কিছু কর্মকান্ডে যুক্তরাষ্ট্রের পদক্ষেপ নিতে কালক্ষেপণ করায় অনেক দেশই ভাবছে, যুক্তরাষ্ট্রের আর আগের মতো শক্তি-সামর্থ্য নাই। এখন সৌদি আরব যদি চীনের সঙ্গে তেল বেচার ক্ষেত্রে ইউয়ান ব্যবহার করে, তা ৫০ বছর ধরে একচ্ছত্র রাজত্ব করা ডলারের প্রভাবকে হ্রাস করবে এবং আন্তর্জাতিক অর্থবাজারে চীনের মুদ্রা ইউয়ানের অবস্থানকে শক্তিশালী করবে। এর পাশাপাশি ইউক্রেনে রুশ আগ্রাসন শুরু হওয়ায় পশ্চিমা দেশগুলো রাশিয়ার ওপর যে ধারাবাহিক নিষেধাজ্ঞা দিয়ে যাচ্ছে তাতে রুবলের পতন ঘটেছে ব্যাপক হারে। এদিকে মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের একজন মুখপাত্র বলেছিলেন যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তার মিত্রদের তাদের এবং চীনের মধ্যে থেকে বেছে নিতে বলছে না। মার্কিন ডলারে তেল ক্রয় হ্রাসের অর্থ হল কম আন্তর্জাতিক ক্রেতাদের কাছে উদ্বৃত্ত মার্কিন মুদ্রা থাকবে যা পুনর্ব্যবহৃত করা প্রয়োজন, যা সাধারণত বাণিজ্য বা বিনিয়োগের মাধ্যমে করা হয় এবং এতে ডলারের তেজীভাব আন্তর্জাতিক লেনদেন ব্যবস্থায় অব্যাহত থাকে। বিপরীতে, একটি ইউয়ানে তেল বিক্রি চীনের জন্য একইধরনের গতিশীলতা বাড়াবে, সম্ভাব্য বাণিজ্য ও বিনিয়োগ বৃদ্ধির দিকে তা পরিচালিত করবে। এতে বেইজিং বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ অবকাঠামো প্রকল্পগুলির জন্য আরো অধিক উদ্যোগী হওয়ার জন্যে সাহসী হয়ে উঠবে। গত সপ্তাহে, সৌদি আরামকো, রাজ্যের রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন তেল কর্পোরেশন, ঘোষণা করেছে যে এটি উত্তর-পূর্ব চীনে একটি বিশাল নতুন তেল এবং পেট্রোকেমিক্যাল শোধনাগার নির্মাণে সহায়তা করবে। এটি নির্মিত হলে প্রতিদিন ৩ লাখ ব্যারেল তেল উৎপাদন হবে। এতে বছরে ১.৫ মিলিয়ন মেট্রিক টন ইথিলিন ক্র্যাকার এবং ১.৩ মিলিয়ন মেট্রিক টন প্যারাক্সিলিন উৎপাদন ইউনিট থাকবে। ১৯৮০-এর দশকের গোড়ার দিকে একটি অনুরূপ চুক্তি তেলের বাজারে আধিপত্য তৈরি করতে সাহায্য করেছিল যা তার মূল্যকে ভেঙে ফেলে, সোভিয়েত ইউনিয়নকে তার প্রথম মন্দার দিকে নিয়ে যায় এবং ১৯৯১ সালে সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রের চূড়ান্ত পরিণতি টেনে আনে। গত বছর, বাইডেন প্রশাসন ইয়েমেনি হুথি আন্দোলনের বিরুদ্ধে সৌদি আরবের যুদ্ধের পক্ষে আক্রমণাত্মক সমর্থন বন্ধ করে। ২০১৫ সালে যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর প্রায় ৪ লাখ ইয়েমেনি মারা গেছে। তবে এই মাসের শুরুতে দ্য আটলান্টিকের সাথে একটি সাক্ষাৎকারে, সৌদি যুবরাজ বিন সালমান বলেন, বাইডেন তাকে বোঝেন কি না তা আমি পাত্তা দেই না। যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থ নিয়ে চিন্তা তার ওপরই বর্তায়।