[ATTACH=CONFIG]17169[/ATTACH]
ক্রমবর্ধমান তীব্র অর্থনৈতিক সংকটে অনেকটাই নুয়ে পড়েছে এশিয়ার দ্বীপ রাষ্ট্র শ্রীলঙ্কা। গত কয়েক বছরে চীন, ভারত ও ইরানসহ অন্যান্য যেসব জায়গা থেকে ঋণ নিয়েছে তা পরিশোধে ব্যর্থতার মুখে পড়েছে দেশটির সরকার। জ্বালানি, খাদ্য, তারল্য সংকট এতটাই চরমে পৌঁছেছে, নিরুপায় হয়ে সরকারের বিরুদ্ধে পথে নেমেছে সাধারণ মানুষ। পরিস্থিতি আরও খারাপের দিকে যাওয়ার আশঙ্কায় জ্বালানি পাম্পসহ দেশের গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনার বাইরে মোতায়েন করা হয়েছে সেনাবাহিনী। শ্রীলঙ্কার অর্থনৈতিক সংকট গভীর থেকে আরও গভীরতর হচ্ছে। সপ্তাহান্তে জ্বালানি তেলের জন্য দীর্ঘক্ষণ লাইনে দাঁড়িয়ে থাকা দুই জ্যেষ্ঠ নাগরিকের মৃত্যু হয়েছে। রান্নার জ্বালানি গ্যাসের দাম শ্রীলঙ্কার মুদ্রায় এক হাজার ১৫০ রুপি থেকে বেড়ে চার হাজার ছাড়িয়েছে। অর্থনৈতিক সংকটের প্রভাব পড়েছে জরুরি খাদ্যপণ্যে। শিশু খাদ্য গুঁড়ো দুধ বিক্রি হচ্ছে চড়া দামে। অর্থের অভাবে কাগজ ছাপা বন্ধের ফলে সম্প্রতি দেশটির কয়েক লাখ শিক্ষার্থীর পরীক্ষা বাতিল করতে বাধ্য হয়েছে সরকার। ১৯৪৮ সালে স্বাধীনতা অর্জনের পর দেশটির ইতিহাসের সবচেয়ে খারাপ অর্থনৈতিক মন্দার কবলে পড়েছে শ্রীলঙ্কা। মূলত ২০২০ সালে করোনার মহামারির ধাক্কার ফলে বিপর্যয় আরও তীব্র হয়েছে। ওই সময় পশ্চিমা দেশগুলোতে কর্মরত অনেক শ্রীলঙ্কান কর্মী চাকরি হারিয়ে দেশে ফিরতে বাধ্য হন। দেশের মধ্যেও সংক্রমণ মারাত্মক আকারে পৌঁছায় বাধ্য হয়ে অনেক গার্মেন্ট কারখানা এবং চা বাগান বন্ধ হয়ে যায়। কাজ হারিয়ে ঘরে বেকার বসে থাকে লাখ লাখ শ্রমিক। বেড়ে যায় বেকারত্বের হার। মহামারিতে সংকট মোকাবিলায় হিমশিম খায় সরকার। সংক্রমণের ধাক্কায় পর্যটন খাত বন্ধ হয়ে গেলে সংকট আরও তীব্র হয়। সব মিলিয়ে, রফতানি ও রেমিট্যান্সের মতো অন্যতম বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনকারী খাতগুলো একটা বড় ধরনের ধাক্কা খায়। সংকট মোকাবিলায় আমদানি কমিয়ে ডলার জমা রাখার উদ্যোগেও ব্যাপক অনিয়মের কথাও উঠে এসেছে। সংকট উত্তরণে তখন থেকেই বড় ধরনের কৌশলের অভাব লক্ষ করা যায়। গত বছরে বেশ কিছু সিদ্ধান্তও নেয় মাহিন্দা রাজাপাকসের সরকার। এরমধ্যে হঠাৎ করেই অর্গানিক কৃষি চাষে পরিবর্তন আনা হয়। এটিকে অবিবেচনাপ্রসূত সিদ্ধান্ত হিসেবে দেখা হয়। এমন বেশ কিছু অপরিকল্পিত পদক্ষেপ শ্রীলঙ্কার চলমান সমস্যা আরও বাড়িয়ে তুলেছে। গত বছর সেপ্টেম্বরে অর্থনৈতিক জরুরি অবস্থা জারি করা হয় শ্রীলঙ্কায়। খাদ্যমূল্যের দাম বাড়ায় ব্যাপক দরপতন ঘটেছে মুদ্রার। আর এ কারণেই জরুরি অবস্থা ঘোষণা করেন প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপাকসে। তখন বিবৃতিতে তিনি বলেন অনুমোদিত কর্মকর্তারা প্রয়োজনীয় খাদ্যসামগ্রীর মজুত ক্রয় করতে পারবেন। দামে ছাড় দিয়ে প্রয়োজনীয় খাদ্যসামগ্রী জনসাধারণের কাছে পৌঁছে দেওয়ার পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। কিন্তু তাতে বিপত্তি আরও বাড়ে। ডলার বাঁচাতে আমদানি বিধিনিষেধের মধ্যে সরকারের প্রয়োজনীয় খাদ্য সামগ্রী বিতরণের জন্য জরুরি বিধি ঘোষণার ফলে বাজারে ব্যাপক অনিয়ম এবং মজুদের কারসাজির খবর পাওয়া গেছে। ২০২১ সালের শেষ নাগাদ জাতীয় ঋণ পরিশোধের ব্যর্থতার আশঙ্কা দেখা দেয়। কারণ, দেশের বৈদেশিক রিজার্ভ ১৬০ কোটি ডলারে নেমে এসেছে। পাশাপাশি যেসব দেশ থেকে ঋণ নিয়েছে লঙ্কান সরকার, তা পরিশোধের সময় ঘনিয়ে এসেছে। কিন্তু শ্রীলঙ্কার ঋণ নেওয়া অব্যাহত ছিল। একই সময়ে জরুরি খাদ্য, জ্বালানি, মেশিনারি আমদানিতে পর্যাপ্ত ডলারের মজুত না থাকার মধ্য দিয়ে ২০২২ সাল শুরু হয়। এতে ঘাটতি আরও বাড়ে এবং অর্থনৈতিক বিপর্যয় দেখা দেয়।সামষ্টিক অর্থনৈতিক স্তরে সব সূচক উদ্বেগজনক। শ্রীলঙ্কার রুপি মার্কিন ডলারের বিপরীতে ২৬৫-তে নেমেছে। আর ফেব্রুয়ারির শেষ দিকে ভোক্তা মূল্যস্ফীতি ১৬.৮ শতাংশ এবং বৈদেশিক রিজার্ভ ছিল ২৩১ কোটি ডলার। উদ্বেগজনক বিষয় হলো, আগের বৈদেশিক ঋণ গলার কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়েছে শ্রীলঙ্কার সরকারের। চলতি বছরেই প্রায় ৭০০ কোটি ডলার বৈদেশিক ঋণ অবশ্যই পরিশোধ করতে হবে দেশটিকে। ঋণ পরিশোধের পাশাপাশি দেশের সার্বিক অবস্থা নিয়ন্ত্রণের ব্যয়ও এই মজুত ডলার থেকেই করতে হবে। এমন ক্রান্তিলগ্নে সম্প্রতি দেশটির প্রেসিডেন্ট রাজাপাকসে জাতির উদ্দেশে এক ভাষণে বলেন, এ বছর ২২০০ কোটি ডলারের আমদানি সংক্রান্ত ব্যয় বহন করতে হবে শ্রীলঙ্কাকে। ফলে বাণিজ্য ঘাটতি বেড়ে দাঁড়ায় ১ হাজার কোটি ডলার। নাগরিকদের জন্য এমন বার্তার যে অর্থ দাঁড়ায় তা হলো জ্বালানির জন্য দীর্ঘ লাইনের অপেক্ষা রান্নার গ্যাসের ঘাটতি, বিভিন্ন এলাকায় বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন হওয়ার পাশাপাশি আরও ভোগান্তি এবং রোগীদের জন্য ওষুধ খোঁজার একটা দীর্ঘ লড়াই। এই বিপর্যয়ে সরকার বাস্তবসম্মত পদক্ষেপ নিতে পারেনি। যেসব নেওয়া হয়েছে সেগুলোতে উল্টো প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে নাগরিকদের মধ্যে। সাধারণ জনগণের পাশাপাশি বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর একাংশকে সরকারের বিরুদ্ধে পথে নামতে দেখা গেছে। এদের অনেকে প্রেসিডেন্ট রাজাপাকসের বাড়িতে ঢুকে যাওয়ার চেষ্টাও করেন। তবে নিরাপত্তা বাহিনীর বাধায় তা সম্ভব হয়ে উঠেনি। এদিকে দেশটির অনেক সংবাদ মাধ্যমও সরকারের সমালোচনায় মেতেছে। করোনা মহামারির চ্যালেঞ্জের দিকে ইঙ্গিত করে প্রেসিডেন্ট রাজাপাকসে বলেন এই সংকট আমার দ্বারা সৃষ্টি হয়নি। অনেক অর্থনীতিবিদ সংকট উত্তরণে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ)-এর সহযোগিতা গ্রহণকে সরকারের একমাত্র উপায় বললেও ক্ষমতাসীনরা এই পথে হাঁটতে নারাজ ছিল। সম্প্রতি ব্যাপক বিক্ষোভ ও সমালোচনার মুখে সরকার নীতিগতভাবে ইউটার্ন নিয়েছে। রাজাপাকসে বলেন সরকার এখন বন্ড পরিশোধে উপায় খুঁজে বের করার জন্য আইএমএফ-এর সঙ্গে আলোচনা শুরু করছে। এই মুহূর্তে আইএমএফ শ্রীলঙ্কাকে কীভাবে সহায়তা করবে এবং দেশটির খাদে পড়া অর্থনৈতিক সংকট মোকাবিলায় কতটা সাহায্য করতে পারবে তা দেখার বিষয়। ইতোমধ্যে কলম্বো ভারতসহ বিভিন্ন দ্বিপাক্ষিক অংশীদারদের কাছ থেকে ঋণ এবং মুদ্রা বিনিময়ের পাশাপাশি জরুরি প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র আমদানির জন্য ঋণ সহায়তা চেয়েছে।