[ATTACH=CONFIG]17409[/ATTACH]
চলতি অর্থবছরের ৯ মাসেই আমদানি ব্যয় ৫৬ দশমকি ২৭ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে গিয়েছে, যা গত অর্থবছরের পুরো সময়ের চেয়েও অনেক বেশি। অথচ অর্থবছরের এখনো দুই মাস ২০ দিন অবশিষ্ট রয়েছে। কয়েকটি পণ্য দ্বিগুণের বেশি আমদানি হয়েছে এ সময়ে। এর মধ্যে তৈরি পোশাক খাত, রাসায়নিক কাঁচামাল, শিল্পের মধ্যবর্তী পণ্য, তুলা, ইয়ার্ন, সার, কাগজের আমদানি ব্যয় দিগুণ হয়েছে। খাদ্যপণ্যর মধ্যে চিনি ও ভোজ্যতেল আমদানি দ্বিগুণ হয়েছে। আর আমদানি ব্যয় বৃদ্ধির পেছনে অন্যতম ভূমিকা রেখেছে সাম্প্রতিক সময়ে ডলারের দাম অধিকহারে বেড়ে যাওয়ার বিষয়টি। তৈরি পোশাক খাত-সংশ্লিষ্টরা বলছেন, তুলাসহ কয়েকটি কাঁচামালের দাম বৃদ্ধিতে আমদানি ব্যয় বেড়েছে তৈরি পোশাক খাতে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ডলারের বিনিময় মূল্য বৃদ্ধি। সার্বিক দিক দিয়ে পণ্যর আমদানি মূল্য বেড়েছে কিন্তু পণ্যর পরিমাণ বাড়েনি। এ সংক্রান্ত বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ তথ্য অনুযায়ী চলতি অর্থবছরের গত প্রায় ৯ মাসে (২০২১ সালের জুলাই থেকে ২০২২ সালের মার্চ) পর্যন্ত আমদানি ব্যয় দাঁড়িয়েছে ৫৬ দশমিক ২৭ বিলিয়ন ডলার। স্থানীয় মুদ্রায় যা চার লাখ ৮৫ হাজার ১১৭ কোটি ৯৯ লাখ টাকা। গত ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত যা ছিল ৫২ দশমিক ৬০ বিলিয়ন ডলার। শুধু মার্চ মাসের ২৩ দিনে আমদানি ব্যয় পরিশোধ হয়েছে তিন দশমিক ৬৭ বিলিয়ন ডলার। অথচ গত ২০২০-২১ অর্থবছরে দেশে আমদানি ব্যয় পরিশোধ করতে হয়েছিল চার লাখ ৩২ হাজার ৪০৪ কোটি টাকা। এর আগের অর্থবছর ২০১৯-২০ আমদানি ব্যয় ছিল তিন লাখ ৮৬ হাজার ২৪৯ কোটি টাকা। ২০১৮-২০১৯ সালে ব্যয় হয়েছিল চার লাখ ৩৮ হাজার কোটি টাকা। এ হিসেবে ৯ মাসের মধ্যেই আমদানি ব্যয় বেড়েছে গত অর্থবছরের পুরো সময়ের চেয়ে ৫৩ হাজার কোটি টাকার বেশি। আমদানি ব্যয় বাড়লেও ব্যবসা বাড়ছে না বলে মনে করছেন তৈরি পোশাক খাতের উদ্যোক্তারা। এ বিষয়ে বাংলাদেশ নিটওয়্যার ম্যানুফ্যাক চারারস অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিকেএমইএ) এক্সিকিউটিভ প্রেসিডেন্ট মোহাম্মাদ হাতেম বলেন এই মুহূর্তে এক পাউন্ড তুলা আমদানিতে ব্যয় হচ্ছে এক ডলার ৪০ সেন্ট। গত বছরের জানুয়ারিতে যা ছিল মাত্র ৬০ সেন্ট। ওই সময়ের পর থেকেই বাড়তে শুরু করেছে দাম। ২০২০ সালের নভেম্বরে প্রতি পাউন্ড সুতার দাম ছিল দুই ডলার সেন্ট। এটা এখন পাঁচ ডলার ২০ থেকে ৩০ সেন্ট। বাংলাদেশে সুতার দাম আন্তর্জাতিক বাজারের তুলনায় ৬০ সেন্ট বেশি। বাংলাদেশের ব্যবসায়ীরা মনের মাধুরি মিশিয়ে সুতার দাম বাড়িয়েছে। পূর্ব থেকেই আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে বাংলাদেশের সুতার দাম বরাবরই বেশি থাকে। কিন্তু করোনার সুযোগ নিয়ে তারা এখন ইচ্ছামতো দাম বাড়াচ্ছে। কখনও কখনও পাউন্ডপ্রতি এক ডলার বেশি দাম নেয়া হচ্ছে। শুধু আমদানি ব্যয় বৃদ্ধি পায়নি একই সঙ্গে বেড়েছে নতুন আমদানিপত্র (এলসি) খোলার হারও। তথ্য বলছে, চলতি অর্থবছরের গত ৯ মাসে নতুন এলসি খোলা হয়েছে ৬৩ দশমিক ৫৩ বিলিয়ন ডলারের। গত অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে এলসি খোলার প্রবণতা বেড়েছে ৪৯ দশমিক ১৩ শতাংশ। চলতি অর্থবছরের গত আট মাসে এলসি নিষ্পত্তির অপেক্ষায় রয়েছে ২৮ দশমিক ৩৪ বিলিয়ন। গত অর্থবছরের একই সময়ে নিষ্পত্তির অপেক্ষায় ছিল মাত্র ১১ দশমিক ৭৭ বিলিয়ন ডলার। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, গত অর্থবছরের আলোচিত সময়ের মধ্যে সর্বোচ্চ ছয় গুণ বেশি ব্যয় গিয়েছে ওষুধ আমদানিতে। এখানেই ব্যয় হয়েছে ৫৫ কোটি ৬৪ লাখ ডলার। গত অর্থবছরের আট মাসে আমদানি ব্যয় হয়েছিল মাত্র ৬৯ লাখ ডলারের। এ অর্থবছরে এ খাতে আমদানি বেড়েছে ৬২২ দশমিক ৭৫ শতাংশ। অন্যদিকে একক খাত হিসাবে বরাবরই আমদানিতে শীর্ষ রয়েছে তৈরি পোশাক খাত। ইয়ার্ন (কটন ও সিনথেটিক্স মিক্সড) পণ্য আমদানি বেড়েছে ১১০ শতাংশের বেশি। চলতি অর্থবছরে এ খাতে আমদানি হয়েছে তিন বিলিয়ন ডলারের। গত অর্থবছরের এই সময়ে আমদানি হয়েছিল এক দশমিক ৩৯ বিলিয়ন। কাঁচা তুলা ও সিনথেটিক ফাইবার আমদানিতে ব্যয় হয়েছে দুই দশমিক ২৩ বিলিয়ন ডলার। এ খাতে আগের চেয়ে ৩৮ শতাংশ বেশি আমদানি হয়েছে। একইভাবে খাদ্যপণ্যের মধ্যে চিনি ৯৩ শতাংশ, ভোজ্যতেল ৯৪ দশমিক ৫২ শতাংশ, রাসায়নিক দ্রব্য ৭৮ দশমিক ৩২ শতাংশ, রাসায়নিক সার ১২০ শতাংশ, কয়লা ১৩৩ শতাংশ, কাগজ ১৩৮ দশমিক ৬৪ শতাংশ ও মূলধনি যন্ত্রাংশ ৪৫ শতাংশ আমদানি বেড়েছে। করোনার নেতিবাচক প্রভাবে ২০২০ সালের পুরোটা সময় ও ২০২১ সালের মধ্যবর্তী পর্যন্ত অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড বলা যায় অচলই ছিল। ব্যবসা-বাণিজ্য ও বিনিয়োগে স্থবিরতা ছিল। কিন্তু জরুরি বিবেচনায় একপর্যায়ে খুলে দেয়া হয় তৈরি পোশাক খাত। এর পূর্ব থেকে অবশ্য অন্যান্য উৎপাদনমুখী শিল্পকারখানা খোলা ছিল। সাম্প্রতিক করোনার প্রভাব কমায় মানুষের চলাচল বেড়েছে, ব্যবসা-বাণিজ্য ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টায় রয়েছে। এজন্য আমদানি চাহিদা বৃদ্ধি পায়। কিন্তু আমদানি চাহিদার পরিমাণকে অস্বাভাবিক বলছেন অর্থনীতিবিদরা। আমদানি দায় মেটাতে গিয়ে ইতোমধ্যে টাকার বিপরীতে ডলারের বিনিময় মূল্য বেড়ে চলেছে। এক বছরের ব্যবধানে ডলারের বিনিময় মূল্য ৮৪ টাকা থেকে এখন ৮৬ টাকা ২০ পয়সায় উন্নীত হয়েছে। খোলা বাজারে ডলার পেতে ব্যয় করতে হচ্ছে ৯১ থেকে ৯২ টাকা। বিশ্লেষকরা বলছেন, অতিরিক্ত আমদানি চাপে বৈদেশিক মুদ্রাবাজার স্থিতিশীল নয়। প্রতিনিয়ত বাড়ছে ডলারের বিনিময় মূল্য। এতে পণ্যর দাম আগের চেয়ে বেশি পরিশোধ করতে হচ্ছে। পণ্য ক্রয় চুক্তির সময়ে ডলারের যে বিনিময় মূল্য ধরা হয়েছিল, কয়েক মাস পরে অর্থপরিশোধের সময়ে তার চেয়ে বেশি ব্যয় হচ্ছে। এতে পণ্যর দামও বাড়ছে। এজন্য আমদানি পণ্যর ওপর নিয়ন্ত্রণ আনা জরুরি। নইলে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের ওপর চাপ পড়বে।