গত মাসে সূচক ও লেনদেনের হিসাবে ইতিবাচক প্রবণতার মধ্য দিয়ে পার করেছে দেশের পুঁজিবাজার। বাজার চাঙা রাখার ক্ষেত্রে মূল ভূমিকা রেখেছে বস্ত্র, প্রকৌশল, ওষুধ ও রসায়ন, বহুজাতিক কয়েকটি কোম্পানি এবং ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক খাত। তবে মৌলভিত্তির কোম্পানিগুলোর দর এক জায়গাতেই দাঁড়িয়ে আছে। অর্থাৎ বাজারে সূচক ওঠানামায় বড় ভূমিকা রেখেছে দুর্বল কোম্পানিগুলো। এই কারণে বাজারের স্থিতিশীল প্রবণতা কত দিন টিকবে, তা নিয়ে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। বাজার বিশ্লেষণে দেখা যায়, জুলাইয়ের শেষ দিন থেকে পুঁজিবাজারের ঘুরে দাঁড়ানো শুরু হয়। গত এক মাসে ২১ কর্মদিবসের মধ্যে ১৫ দিনে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে (ডিএসই) সূচক প্রায় ৫০০ পয়েন্ট বেড়েছে। গত বৃহস্পতিবারসহ শেষ ছয় দিনে টানা বাড়ল ২২৭ পয়েন্ট। সূচকের পাশাপাশি লেনদেনও ২ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়েছে একাধিক কর্মদিবসে। দুই মাস ধরে লেনদেনে বস্ত্র খাতের যে প্রাধান্য দেখা গেছে, সেটি আরও বেড়েছে। সূচকের ঊর্ধ্বগতির মধ্যে বিনিয়োগকারীরা তাঁদের আগের লোকসানের হিসাব-নিকাশে ব্যস্ত। দরপতনের কারণে যত টাকা গেল, তার কত ফিরল, তা নিয়েই চলছে আলোচনা। তবে পুঁজিবাজার বিশেষজ্ঞদের কেউ কেউ মনে করছেন, বাজারে মৌলভিত্তির শেয়ারের ভূমিকা কম থাকায় দীর্ঘ মেয়াদে তা টেকসই হবে না। কারণ, শুধু দুর্বল কোম্পানি নিয়ে নাড়াচাড়া হলে বাজার যেকোনো সময় অস্থিতিশীল হয়ে পড়তে পারে। তবে কেউ কেউ আবার ব্যাংকের বিনিয়োগসীমা ক্রয়মূল্যে গণনাসহ সরকারের নীতিসহায়তা বাজারকে দীর্ঘ মেয়াদে স্থিতিশীল রাখবে বলে আশা করছেন।
[IMG]http://forex-bangla.com/customavatars/1887549080.jpg[/IMG]
গত তিন মাসে ওরিয়ন ইনফিউশনের দাম প্রায় চার গুণ বেড়েছে। দুটি একেবারে দুর্বল কোম্পানিসহ আরও চারটির দাম বেড়েছে দ্বিগুণের বেশি। দাম বাড়ার বিষয়ে এসব কোম্পানিকে একাধিকবার সতর্ক করা হলেও তারা মূল্যবৃদ্ধির পেছনে সংবেদনশীল কোনো তথ্য নেই বলে ডিএসইকে জানায়। মূল্যসূচকের স্থবিরতার কালেও এসব কোম্পানির শেয়ারের দাম ব্যাপক বেড়েছে।

এ কারণে এসব শেয়ারের ‘অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধির’ পেছনে কারসাজি রয়েছে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকেরা।

গত বৃহস্পতিবার পর্যন্ত তিন মাসে ওরিয়ন ইনফিউশনের দাম ৮২ টাকা থেকে বেড়ে ৩১০ টাকা ৩ পয়সা হয়েছে। এটি এ ক্যাটাগরিতে থাকলেও মূল্যবৃদ্ধির হার অস্বাভাবিক। এই সময়ে তুলনামূলক কম দুর্বল ‘বি’ ক্যাটাগরিতে থাকা বস্ত্র খাতের শেয়ার সোনারগাঁও টেক্সটাইলের দর ৩৪ টাকা ৩ পয়সা থেকে ৬৬ টাকা ২ পয়সায় উঠেছে। এই কোম্পানি ২০১৯ সালে মাত্র ৩ শতাংশ লভ্যাংশ দেওয়ায় এটাকে এ ক্যাটাগরি থেকে নামিয়ে দেওয়া হয়।

এই তালিকার সবচেয়ে দুর্বল ‘জেড’ ক্যাটাগরির শেয়ার মেঘনা কনডেন্স মিল্ক পাঁচ বছর ধরে টানা লোকসানে থাকায় শেয়ারহোল্ডারদের কোনো লভ্যাংশ দেয়নি। অথচ গত তিন মাসে এর দর ২০ টাকা ৯ পয়সা থেকে বেড়ে ৪২ টাকায় উঠেছে।
লংকাবাংলা ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসের বিশ্লেষণ বলছে, জুলাইতে ডিএসইতে যে ১০টি কোম্পানির শেয়ারের দাম সবচেয়ে বেড়েছিল, তার মধ্যে ৫টির মৌলভিত্তি ছিল দুর্বল। এর মধ্যে সর্বোচ্চ ৪৮ দশমিক ৯৪ শতাংশ দর বেড়ে শীর্ষে ছিল মেঘনা কনডেন্স মিল্ক। দ্বিতীয় অবস্থানে থাকা জেড ক্যাটাগরির শেয়ার বিআইএফসিরও একই অবস্থা। এটির দাম বেড়েছে ৪৮ দশমিক ৪৪ শতাংশ। আর পঞ্চম, অষ্টম ও দশম স্থানে থাকা তিন কোম্পানি তুলনামূলক কম দুর্বল ‘বি’ ক্যাটাগরির শেয়ার। এর মধ্যে সানলাইফ ইনস্যুরেন্সের দর ৩৩ দশমিক ০৪ শতাংশ, ইস্টার্ন কেব্*লসের দর ২৬ দশমিক ২৫ শতাংশ এবং প্রাইম টেক্সটাইলসের দর ২১ দশমিক ৮৩ শতাংশ বেড়েছে।
শেয়ারের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধির বিষয়ে নিয়মিতই স্টক এক্সচেঞ্জের পক্ষ থেকে কারণ দর্শানো হলেও বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই এসব কোম্পানির বিরুদ্ধে কার্যকর কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয় না। এ কারণে বছরের পর বছর বাজে কোম্পানিগুলো বাজারে টিকে আছে এবং সেগুলোকে নিয়েই কারসাজি হয় বলে বাজারসংশ্লিষ্টরা মনে করেন।
দুর্বল কোম্পানিগুলোর দাম বাড়ার কারণ ব্যাখ্যা করে আবু আহমেদ বলেন, সাধারণ বিনিয়োগকারীদের বেশির ভাগের প্রবণতা হলো তাৎক্ষণিক লাভ করা, যার ফলে তাঁরা কোম্পানি বাছাইয়ে প্রাজ্ঞ সিদ্ধান্ত নিতে পারেন না। দাম বাড়তে দেখলে বা বাড়বে বলে গুজব শুনলেই কোনো কোম্পানিতে বিনিয়োগ করে ফেলেন। স্বল্প মেয়াদে দাম খুব বেশি না বাড়লেও বা কমলেও মৌলভিত্তির কোম্পানি বছরে চারবার লভ্যাংশ ঘোষণা করবে, ভালো মুনাফা আসবে। এগুলো নিয়ে সহজে কারসাজি করা যায় না, ফলে বিনিয়োগ অনেকটাই ঝুঁকিমুক্ত থাকে। কিন্তু দুর্বল কোম্পানিতে লোভে পড়ে বা গুজবে কান দিয়ে বিনিয়োগকারীরা প্রতিনিয়তই পথে বসেন।
পুঁজিবাজারকে টেকসই করতে হলে মৌলভিত্তির শেয়ারের ভূমিকা বাড়াতে হবে বলে মনে করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক এই অধ্যাপক। তিনি বলেন, ‘মৌলভিত্তির অনেক বহুজাতিক কোম্পানি বহুদিন ধরে দেশে ব্যবসা করে বিপুল মুনাফা করছে, কিন্তু জনগণকে তারা ভাগ দিচ্ছে না। বিশ্বের কোনো দেশে এমনটি ঘটে না। প্রতিবেশী দেশ ভারত থেকেই সরকার অনেক শিক্ষা নিতে পারে। ভারতে বোম্বে স্টক এক্সচেঞ্জে শীর্ষ কোম্পানিগুলোর তালিকায় আছে নেসলে, এশিয়ান পেইন্টস ও হিন্দুস্তান লিভার। এগুলো বাংলাদেশেও ব্যবসা করছে, কিন্তু তালিকাভুক্ত হচ্ছে না। নেসলের তৈরি কত পণ্য ভোগ করি, অথচ তাদের কাছ থেকে আমরা কিছু পাচ্ছি না।’