রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের এক বছর পূর্ণ হচ্ছে চলতি সপ্তাহে। এই যুদ্ধের জেরে বৈশ্বিক বাজারে জ্বালানির দাম বেড়েছে, যার প্রভাব পড়েছে অর্থনীতির সব খাতে; বিঘ্নিত হয়েছে সরবরাহব্যবস্থা, বেড়েছে পরিবহন ব্যয়, আকাশ ছুঁয়েছে মূল্যস্ফীতি। দিন কয়েক আগে প্রথম আলোর একটি সংবাদে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের এক পঙ্গু বৃদ্ধের করুণ জীবনের চিত্র উঠে আসে। বৃদ্ধের ভাষ্যমতে, জিনিসপত্রের দাম যে হারে বেড়েছে আর তাঁর যা আয়, তাতে বছরে দুই-একবারের বেশি মাংস খেতে পারছেন না তিনি। সেই সঙ্গে আরেকটি খবরে জানা যায়, ২০২২ সালের জুলাই মাসের তুলনায় ডিসেম্বরে দেশে ইন্টারনেট ব্যবহারকারী কমেছে ৩২ লাখ।
[IMG]http://forex-bangla.com/customavatars/846703119.jpg[/IMG]
এই দুটি প্রসঙ্গ টেনে আনার অর্থ হলো, সীমিত ও নিম্ন আয়ের মানুষ এখন মূল্যস্ফীতির চাপে আছেন। সেই চাপ সামলাতে তাঁদের নানাভাবে পারিবারিক ব্যয় কাটছাঁট করতে হচ্ছে। এই অবস্থা শুধু বাংলাদেশে নয়, বিশ্বের অনেক দেশেই দেখা যাচ্ছে। মিসর থেকে শুরু করে শ্রীলঙ্কা, বাংলাদেশ—সব খানেই একই অবস্থা। এর প্রধান কারণ রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ। এই এক যুদ্ধের জেরে বৈশ্বিক বাজারে জ্বালানির দাম বেড়েছে, যার প্রভাব পড়েছে অর্থনীতির সব খাতে; বিঘ্নিত হয়েছে সরবরাহব্যবস্থা, বেড়েছে পরিবহন ব্যয়, আকাশ ছুঁয়েছে মূল্যস্ফীতি। এগুলো এখন বিশ্বজনীন সমস্যা।
ইউক্রেন পৃথিবীর অন্যতম খাদ্যভান্ডার। যুদ্ধের কারণে তারা টানা কয়েক মাস খাদ্য রপ্তানি করতে পারেনি। ফলে বেড়ে যায় খাদ্যের দাম। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি কর্মসূচির সূচক রেকর্ড উচ্চতায় ওঠে। এরপর একপর্যায়ে কৃষ্ণসাগর দিয়ে খাদ্য চলাচলের চুক্তি হয় রাশিয়া ও ইউক্রেনের মধ্যে। তার পর থেকে খাদ্যের দাম আবার কমতে শুরু করে। আগামী মাসে এই চুক্তি আবার নবায়ন করতে হবে।
মূল সমস্যা হয়েছে জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধির কারণে। যুদ্ধ শুরুর আগে থেকেই জ্বালানির দাম বাড়ছিল। যুদ্ধ শুরু হয়ে গেলে জ্বালানি তেলের ব্যারেলপ্রতি দাম এক ধাক্কায় ১০০ ডলার পেরিয়ে যায়। একপর্যায়ে তা ১২০-এর ঘরে উঠে যায়। বর্ধিত মূল্যে তেল আমদানি করতে গিয়ে বিপাকে পড়ে দেশগুলো। সেই সঙ্গে সংকটকালে মার্কিন ডলারের বিনিময় মূল্য বেড়ে যায়। ফলে একই পরিমাণ পণ্য আমদানি করতে আগের চেয়ে বেশি ব্যয় করতে হয় দেশগুলোকে। ডলার-সংকটে প্রায় সব দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমে যায়।
খাদ্য উৎপাদন থেকে শুরু করে পরিবহন, উৎপাদন—সবকিছুতেই জ্বালানি ব্যবহার হয়। ফলে জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধির প্রভাব সবকিছুতেই অনুভূত হয়। দেশে দেশে মূল্যস্ফীতির সূচকের আকাশ ছুঁয়ে ফেলার উপক্রম হয়। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) তথ্যানুসারে, ২০২২ সালে বৈশ্বিক গড় মূল্যস্ফীতির হার ছিল ৮ দশমিক ৮। অথচ এর আগে ২০১৭-১৯ সময়ে মূল্যস্ফীতির হার ছিল ৩ দশমিক ৫।
এই পরিসংখ্যান দিয়ে আবার সব দেশের চিত্র বোঝা যায় না; কারণ, পাকিস্তান ও শ্রীলঙ্কার মতো দেশে মূল্যস্ফীতির হার ৩০ শতাংশের ওপর। জিম্বাবুয়েতে খাদ্য মূল্যস্ফীতি ৬০ শতাংশ পেরিয়েছে। আফ্রিকার দেশ নাইজেরিয়াতে গত এক বছরে খাদ্য মূল্যস্ফীতি ৩৭ শতাংশে উঠেছে। রুটির দাম স্রেফ দ্বিগুণ হয়ে গেছে; কারণ, তারা মূলত রাশিয়ার গমের ওপর নির্ভরশীল। এতে সবচেয়ে বিপাকে পড়েন নিম্ন ও সীমিত আয়ের মানুষেরা।
বার্তা সংস্থা এপির সংবাদে বলা হয়েছে, মিসরের বিধবা নারী হালিমা রাবি সংসারের খরচ মেটাতে একসঙ্গে দুটি কাজ করছেন। তাঁর মাসিক আয় এখন ১৭০ ডলার। পরিস্থিতির এত অবনতি হয়েছে যে তিনি এখন মাসে একবার মাংস রাঁধেন।
পরিস্থিতি এত সঙিন যে মিসর সরকার দেশটির মানুষকে প্রোটিনের বিকল্প উৎস হিসেবে মুরগির পা ও পাখা খাওয়ার পরামর্শ দিয়েছে। স্বাভাবিকভাবেই সরকারের এমন পরামর্শে সামাজিক মাধ্যমে ব্যাপক সমালোচনা হয়েছে। অন্যদিকে সরকারের এমন আহ্বানে মুরগির পা ও পাখার দাম বেড়ে গেছে। সরকারের ঘোষণার পর সেই দেশে এখন মুরগির পা ও পাখা কেনাও কঠিন হয়ে গেছে।
শিগগিরই বর্ষপূর্তি হতে চলেছে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের। বিশ্ববাজারে প্রাথমিকভাবে বৃদ্ধির পর জ্বালানি ও খাদ্যের দাম অনেকটাই কমেছে। কিন্তু বার্তা সংস্থা এপির তথ্যানুসারে, প্রাকৃতিক গ্যাসের দাম এখনো প্রাক্​যুদ্ধ সময়ের চেয়ে তিন গুণ বেশি। ফলে এ বছর জার্মানির লন্ড্রিমালিক স্ভেন পারকে ১ লাখ ৭৬ হাজার ডলার গ্যাস বিল দিতে হবে, যা গত বছর ছিল ৩২ হাজার ডলার।
স্বাভাবিকভাবেই এই বর্ধিত মূল্য ক্রেতার ঘাড়েই ঠেলে দিতে হয়েছে পারকে, এপিকে তিনি সে কথাই জানিয়েছেন। বাড়তি মূল্যের কারণে নানাভাবে তাঁর ব্যবসা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। খাদ্যসহ সবকিছুর দাম বেড়ে যাওয়ায় হোটেল-রেস্তোরাঁয় গ্রাহক কমেছে। ফলে টেবিল ক্লথ ধোয়ার চাহিদাও কমে গেছে।

মন্দার আশঙ্কা
রাশিয়া–ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকেই বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা পূর্বাভাস দিয়ে আসছিল, ২০২৩ সালে বিশ্ব অর্থনীতি মন্দার কবলে পড়বে। আইএমএফ বলেছিল, ২০২৩ সালে বিশ্বের এক-তৃতীয়াংশ দেশ মন্দার কবলে পড়বে। বিশ্বব্যাংক বলেছিল, বিশ্ব অর্থনীতি খুবই বিপজ্জনকভাবে মন্দার কাছাকাছি, বিশেষ করে উন্নত দেশগুলো।
গত বছরের অক্টোবরে অর্থনীতিবিদদের ওপর ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের (ডব্লিউইএফ) পরিচালিত এক জরিপে ৭৩ শতাংশ অর্থনীতিবিদ মত দেন যে ২০২৩ সালে মন্দা হতে পারে। তাঁদের মধ্যে ৬৪ শতাংশ মাঝারি গোছের মন্দার আশঙ্কা করেন; বাকি ৯ শতাংশ করছিলেন শক্তিশালী মন্দার আশঙ্কা।
এ পরিস্থিতিতে আইএমএফের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ক্রিস্টালিনা জর্জিয়েভা বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্র এবার হয়তো মন্দা এড়িয়ে যেতে পারবে। দেশটির কর্মসংস্থান ও শেয়ারবাজারের পরিস্থিতি দেখে তিনি এই আশাবাদ ব্যক্ত করেন। তাঁর মতে, গত বছর অর্থনীতিবিদ ও বিশ্লেষকেরা সম্ভবত একটু বেশি হতাশাবাদী ছিলেন। সে কারণে মন্দার পূর্বাভাস একটু বেশি বেশি করা হয়েছে। মন্দা এড়িয়ে গেলেও বিশ্ব অর্থনীতিতে প্রবৃদ্ধির হার কমবে বলেই মনে করছেন জর্জিয়েভা।

এদিকে জাতিসংঘের এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, প্রবৃদ্ধির হার ২০২২ সালের ৩ শতাংশ থেকে কমে চলতি ২০২৩ সালে ১ দশমিক ৯ শতাংশে নেমে আসবে। আইএমএফ বলেছে, তা হতে পারে ২ দশমিক ৯ শতাংশ। আরও কিছু সমীক্ষায় বলা হয়েছে, এ বছর প্রবৃদ্ধির হার কমবেই। আর প্রবৃদ্ধির হার হ্রাস মানেই সাধারণ মানুষের দুর্দশা বৃদ্ধি। যার অবশ্যম্ভাবী অভিঘাত হলো বিশ্বজুড়ে সামাজিক অস্থিরতা বৃদ্ধি।