যুক্তরাষ্ট্রে অর্থনীতিতে মূল্যস্ফীতি ও সুদহারের সম্পর্ক নিয়ে আলোচনা কিছুটা ধাঁধায় পরিণত হয়েছে। মূল্যস্ফীতি প্রত্যাশিত লক্ষ্যের কাছাকাছি পৌঁছলেও নীতি সুদহার নিয়ে ফেডারেল রিজার্ভের সিদ্ধান্ত এখনো স্পষ্ট নয়। অথচ সেদিকেই তাকিয়ে আছেন ওয়াল স্ট্রিটের ব্যবসায়ী থেকে শুরু করে গাড়ি ব্যবসায়ী বা বাড়ির ক্রেতারা। তারা ভাবছেন, এ পরিস্থিতিতে সুদহার কমলে ভারী ঋণের বোঝা অনেকটাই হালকা হবে। ধারণা করা হচ্ছিল, চলতি বছর কয়েক দফা নীতি সুদহার কমিয়ে আনবে ফেডারেল রিজার্ভ। কারণ ২০২৩ সালের দ্বিতীয়ার্ধে লক্ষ্য অনুযায়ী, মূল্যস্ফীতির বার্ষিক বৃদ্ধি ছিল প্রায় ২ শতাংশ। কিন্তু চলতি সপ্তাহে মার্কিন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বেশ কয়েকজন কর্মকর্তা জানান, এখনই সুদ হারের লাগাম টেনে ধরতে প্রস্তুত নন তারা। মূল্যস্ফীতি লক্ষ্যমাত্রায় পৌঁছলেও সুদহার এখন ২২ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। প্রশ্ন হচ্ছে, এখনই কি এ সুদহার কমানোর সময় নয়? এ বিষয়ে ফেডের বেশির ভাগ নীতিনির্ধারক বলছেন, অর্থনীতি ও চাকরির বাজার ক্রমবর্ধনশীল হওয়ায় মূল্যস্ফীতির চাপ কমার বিষয়ে তারা আশাবাদী। কিন্তু সতর্কতারও প্রয়োজন রয়েছে। অর্থনীতি শক্তিশালী হচ্ছে মনে হলেও মূল্যস্ফীতির বাস্তব ঝুঁকি কমেনি।
[IMG]http://forex-bangla.com/customavatars/896445572.jpg[/IMG]
নীতিনির্ধারকদের কেউ কেউ এ নিয়ে চিন্তিত যে এখনই সুদহার কমালে বেড়ে যেতে পারে মূল্যস্ফীতি। ওই পরিস্থিতিতে ফের নীতি সুদহার বাড়াতে বাধ্য হতে পারে ফেড। ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক অব রিচমন্ডের প্রেসিডেন্ট টম বারকিন সম্প্রতি মূল্যস্ফীতির অস্পষ্টতা নিয়ে মন্তব্য করেন। তিনি বলেন, ‘মুদ্রাস্ফীতির দিক ঘুরে যাওয়ার মতো অনেক গল্পই ইতিহাসে আছে। ১৯৮৬ সালে ধারণা করা হয়েছিল, মূল্যস্ফীতি পরাজিত হয়েছে। কিন্তু নীতি সুদহার কমানোর পরের বছর বেড়ে যায় মূল্যস্ফীতি চাপ।’
‘যদি সম্ভব হয় মূল্যস্ফীতির এ রোলার-কোস্টার আচরণ এড়াতে চাই’ বলেও উল্লেখ করেন চলতি বছরে সুদের হার নীতিতে ভোট দেয়া ১২ ফেড কর্মকর্তার অন্যতম টম বারকিন। তিনি ছাড়াও বেশ কয়েকজন কর্মকর্তা বলেছেন, মূল্যস্ফীতি স্থিতিশীল হচ্ছে কিনা তা বোঝার জন্য আরো সময় দরকার। সুদহার কমানো ছাড়াও অর্থনীতি যথেষ্ট শক্তিশালী হয় কিনা দেখতে চান তারা। উদাহরণস্বরূপ, বছরের প্রথম মাসে মার্কিন শ্রমবাজারে নতুন কর্মসংস্থানের উলম্ফন দেখা গেছে, যা পূর্বাভাসের তুলনায় দ্বিগুণ। এ সময় বেকারত্বের হার ছিল ৩ দশমিক ৭ শতাংশ।
বাজার বিশ্লেষক গ্লোবালডেটা টিএস লোমবার্ডের প্রধান অর্থনীতিবিদ স্টিভেন ব্লিটজের মতে, পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণে ফেড আরো সময় নেবে। এর আগে টানা ১১ দফায় সুদহার বাড়িয়েছিল ফেডারেল রিজার্ভ। ক্লিভল্যান্ড ফেডারেল রিজার্ভের প্রেসিডেন্ট লরেটা মেস্টার বলেন, ‘*এখনই সুদহার কমানো জরুরি বলে আমি মনে করি না। এ বছরের শেষ দিকে যদি পরিস্থিতি প্রত্যাশিত পথে থাকে, তবে সুদহার কমতে পারে। এ মুহূর্তে অর্থনীতিতে ‘‘*সফট ল্যান্ডিং’’-এর লক্ষণ দেখা গেলেও মন্দা বা উচ্চ বেকারত্ব সৃষ্টি না করেই মূল্যস্ফীতির চাপ কমতে পারে। কিন্তু সুদের হার যত বেশি থাকবে, তাতে অনেক কোম্পানি ও ভোক্তাদের ঋণ নেয়া ও এ খাতে খরচ বন্ধ হয়ে যাবে। তখন অর্থনীতি দুর্বল হয়ে সম্ভাব্য মন্দার মধ্যে পড়ার ঝুঁকি তত বেশি হবে।’
বিশেষ করে উচ্চ সুদহার আবাসন খাতের ঋণের সঙ্গে ব্যাংকগুলোর টিকে থাকার লড়াইকে আরো জটিল করতে পারে। সে ক্ষেত্রে উচ্চ হারে পুনঃঅর্থায়ন কঠিন হয়ে যাবে। এরই মধ্যে ঋণ বাবদ বাড়তি খরচ এখন অনেকেই মাথাব্যথার কারণ হয়ে গেছে। উদাহরণস্বরূপ, দেড়-দুই বছর আগেও ৩ শতাংশের নিচে সুদহারে অটো লোন পাওয়া যেত। এখন সে সুদহার সর্বনিম্ন ৫ দশমিক ৫ শতাংশ। যে গ্রাহক তিন বছর আগে গাড়ির লিজ পেমেন্ট হিসেবে ৪০০ ডলার খরচ করতেন, তা এখন ৬৫০ ডলারের কাছে।
বেশির ভাগ অর্থনীতিবিদ আশা করেন যে আগামী মে বা জুন নাগাদ বেঞ্চমার্ক হার কমাতে শুরু করবে ফেড, যা এখন প্রায় ৫ দশমিক ৪ শতাংশ। গত ডিসেম্বরে নীতি সুদহার বিষয়ে আলোচনায় অংশ নেয়া ১৯ নীতিনির্ধারকদের মধ্যে দুজন ছাড়া সবাই বলেছিলেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংক চলতি বছর সুদহার কমিয়ে দিতে পারে। এর পরও অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ত্বরান্বিত হয়েছে। গত বছরের শেষ প্রান্তিকে অপ্রত্যাশিতভাবে মার্কিন অর্থনীতি ৩ দশমিক ৩ শতাংশ বার্ষিক হারে সম্প্রসারণ হয়েছে। ব্যবসাও ইতিবাচকভাবে বেড়েছে। তা সত্ত্বেও সফট ল্যান্ডিংয়ের সম্ভাবনা দেখছেন না অনেকে। তাই মূল্যস্ফীতিকে একটি চলমান হুমকি হিসেবে দেখা হচ্ছে।
এসব কারণে ফেডারেল রিজার্ভের চেয়ারম্যান জেরোমি পাওয়েল সম্প্রতি জানান, মূল্যস্ফীতিকে স্থিতিশীল রাখা একটি ঝুঁকিপূর্ণ কাজ। বিকল্প উপায়ের দিকে এখন মনোযোগ তাদের। তাই নীতি সুদহার কমানোর ক্ষেত্রে তাড়াহুড়ো নেই।