ইউরোপের ব্যাংক খাতে সাম্প্রতিক একাধিক অধিগ্রহণের পদক্ষেপ আলোচনায় রয়েছে। উদাহরণ হিসেবে বেশকিছু হাইপ্রোফাইল উদ্যোগের কথা বলা যায়। যেমন রোমানিয়ায় উপস্থিতি সম্প্রসারণের পর জার্মানির কমার্জব্যাংকে অংশীদারি বাড়াচ্ছে ইতালির ইউনিক্রেডিট। অন্যদিকে বহুজাতিক ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি এক্সাকে লক্ষ্য করেছে ফ্রান্সের বিএনপি প্যারিবাস, যখন সাবাদেলকে একীভূতকরণের দিকে এগোচ্ছে বিবিভিএ। ইউরোনিউজের এক প্রতিবেদনে ব্যাংক খাতে একীভূতকরণের এ ঝড়কে এক শব্দে ‘হট’ বললেন হোয়াইট অ্যান্ড কেসের এমঅ্যান্ডএ পার্টনার হাইডার জমাবয়। আর ২০২৫ সালে তা ‘রেড হট’ হতে যাচ্ছে বলেও জানান।
২০০৮ সালে আর্থিক সংকট শুরু হলে ইউরোজোনের ব্যাংক খাতে একীভূতকরণ ও অধিগ্রহণ (এমঅ্যান্ডএ) প্রক্রিয়া উল্লেখযোগ্যভাবে কমে যায়। কিন্তু এর আগে এমঅ্যান্ডএ চুক্তির ক্ষেত্রে আগ্রাসী একটি যুগ প্রত্যক্ষ করেছিল পুরো আর্থিক খাত। সংকট শুরু হলে কঠোর আর্থিক শর্ত ও প্রবিধানের কারণে সীমাবদ্ধ হয়ে যায় এ সম্প্রসারণ। [IMG]http://forex-bangla.com/customavatars/891446813.jpg[/IMG]
স্থানান্তরিত সম্পদের পরিমাণ হিসাব করলে সংকটের আগের দশকের তুলনায় ২০০৮-২০ সাল সময়কালে ব্যাংক শিল্পে এমঅ্যান্ডএ চুক্তি প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ কমে গিয়েছিল।
প্রবিধান এখনো কঠোর থাকলেও সুদহার চুক্তি বৃদ্ধিতে প্রভাবক হিসেবে কাজ করছে বলে জানান বিশ্লেষকরা। এর একটি দিক থেকে গত কয়েক বছরে উচ্চ সুদহার ব্যাংকগুলোকে উল্লেখযোগ্য মুনাফা অর্জনে সাহায্য করেছে, যা অধিগ্রহণের প্রতি কোম্পানিগুলোর আগ্রহ বাড়িয়েছে।
উন্নতির একটি লক্ষণ হলো, ব্যাংকগুলো আগে রাষ্ট্রীয় সহায়তা পেলেও এখন তারা এটি ছাড়াই চলতে পারছে, যা খাতজুড়ে আর্থিক স্থিতিশীলতার উন্নতির ইঙ্গিত দেয়। যেমন এমপিএসের অংশীদারত্ব বিক্রি করছে ইতালি সরকার। অন্যদিকে ন্যাটওয়েস্ট থেকে বেরিয়ে যাচ্ছে যুক্তরাজ্য সরকার।
বিশ্লেষকরা বলছেন, ঋণের খরচ কমার কারণে এমঅ্যান্ডএ চুক্তিতে আগ্রহ বাড়ছে। এখন ঋণদাতারা আয়ের উৎস বৈচিত্র্যময় করার উপায় খুঁজছে।
হাইডার জমাবয় বলেন, ‘গ্রাহক এখন আর আপনার কাছ থেকে একটি পণ্য কিনতে চান না। তারা ছয়টি পণ্য কিনতে চান। এর মানে হলো, অনেক বড় ব্যাংক একই ছাতার নিচে একাধিক ব্র্যান্ড পরিচালনা করছে।’
ব্যাংক খাতের এমঅ্যান্ডএ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সক্ষমতা, অভিজ্ঞতা ও দক্ষতা একত্রিত করতে পারে। যেমন প্রযুক্তি, পণ্য বা সেবা সম্পর্কিত জ্ঞান। ফলে গ্রাহকরা আরো উন্নত সেবা, কম খরচে পণ্য ও সুবিধা পেতে পারেন। তবে এক্ষেত্রে প্রতিযোগিতা বজায় রাখা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। যদি একাধিক ব্যাংক একত্রিত হয়ে খুব বেশি শক্তিশালী হয়ে যায় এবং বাজারে খুব কম প্রতিযোগিতা থাকে, তাহলে গ্রাহক ক্ষতির মুখে পড়তে পারে। যেমন উচ্চ সুদহার বা কম মানের সেবা।
অধিগ্রহণের এ বিস্তার আন্তর্জাতিক পর্যায়ে উন্নীত হলে ভৌগোলিক দক্ষতা ভাগাভাগি করে নেয়া যায়। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বড় ব্যাংকিং প্রতিষ্ঠান ইউরোজোনে প্রতিযোগিতার সক্ষমতা বাড়াতে সাহায্য করতে পারে, যদি এ ব্যাংকগুলো উদ্ভাবনে বিনিয়োগের মতো ভালো অবস্থানে থাকে।
‘বড় ব্যাংকগুলোর জন্য বৈশ্বিকভাবে প্রতিযোগিতার সক্ষমতা গুরুত্বপূর্ণ’ বলে মন্তব্য করেছেন স্কোপ রেটিংসে আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের প্রধান মার্কো ট্রইয়ানো। বিশেষ করে ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংকিংয়ে বড় ব্যালান্স শিট থাকা প্রয়োজন বলে মন্তব্য তার, এতে দক্ষভাবে ঝুঁকি মোকাবেলা করা যেতে পারে।
কিছু বিশেষজ্ঞ বলছেন, এ ধরনের একীভূতকরণে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করছে ‘দেশীয় মনোভাব’। অনেক কর্তৃপক্ষ দেশীয় পর্যায়ে এমঅ্যান্ডএর পক্ষে থাকলেও আন্তঃদেশীয় পর্যায়ের সম্প্রসারণের বিরোধী। ১৯৯৯ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত ইউরো অঞ্চলে ব্যাংকিং একীভূতকরণের প্রায় ৮০ শতাংশ ছিল স্থানীয় পর্যায়ে।
এ ধরনের পক্ষপাতিত্ব বর্তমান চুক্তিতে দৃশ্যমান। ইউনিক্রেডিটের মাধ্যমে জার্মানির কমার্জব্যাংক অধিগ্রহণের বিপক্ষে সম্প্রতি অবস্থান নেন জার্মান চ্যান্সেলর ওলাফ শুলজ। অংশীদারত্বের ধরন নিয়ে প্রশ্ন তুলে তিনি বলেছিলেন, ‘অবাঞ্ছিত আক্রমণ ও শত্রুতাপূর্ণ অধিগ্রহণ ব্যাংকের জন্য ভালো কিছু নয়।’
অবশ্য তাত্ত্বিকভাবে আন্তর্জাতিক একীভূতকরণে সমর্থন জানিয়েছিলেন ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল মাখোঁ। ‘চুজ ফ্রান্স’ সম্মেলনে দীর্ঘকালীন সমর্থন পুনর্ব্যক্ত করে তিনি বলেন, ‘ইউরোপীয় হিসেবে চুক্তি করা মানে ইউরোপীয়দের মধ্যে সংহতি প্রয়োজন।’
রাজনৈতিক সমর্থন থাকা সত্ত্বেও আন্তঃদেশীয় চুক্তিগুলো এখনো প্রশাসনিক বাধার সম্মুখীন হচ্ছে বলে উল্লেখ করা হয়েছে প্রতিবেদনে। ইউরোপীয় ইউনিয়নে এ ধরনের প্রকল্পগুলোয় কমন ডিপোজিট স্কিমের মতো বিষয়ে অগ্রগতি বেশ ধীরগতি।
বড় আন্তঃদেশীয় ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করার সময় স্থিতিশীলতা একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হওয়া উচিত বলে মন্তব্য করেছেন এনজিও ফাইন্যান্স ওয়াচের প্রধান অর্থনীতিবিদ থিয়েরি ফিলিপনাট। কারণ আন্তঃদেশীয় চুক্তি এমন ব্যাংক তৈরি করতে পারে যেগুলোর পতন পুরো অর্থনীতির জন্য বিপর্যয়কর হবে। ব্যাংক অব ইংল্যান্ডের সাবেক গভর্নর মারভিন কিংয়ের উদ্ধৃতি দিয়ে বলেন, ‘ব্যাংকগুলো বেড়ে ওঠে বৈশ্বিকভাবে এবং মারা যায় জাতীয়ভাবে।’
এ পরিপ্রেক্ষিতে ব্যাংকিং ঝুঁকি কার্যকরভাবে ব্যবস্থাপনা করা যায় কিনা সেই প্রশ্ন তীব্রভাবে আলোচনায় রয়েছে। মার্কো ট্রইয়ানোর মতে, একীভূতকরণ হওয়া ব্যাংকে শক্ত তারল্য ভিত্তি থাকবে। এছাড়া এমঅ্যান্ডএ চুক্তি এমনভাবে ঝুঁকি মোকাবেলা উন্নত করতে সহায়ক হতে পারে, যার মাধ্যমে ঝুঁকি আন্তঃদেশীয় পর্যায়ে বিতরণ করা যাবে।
ডোনাল্ড ট্রাম্পে দ্বিতীয় মেয়াদে নীতি শিথিলের সুযোগ দিতে প্রস্তুত হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের আর্থিক খাত। এ কারণে দেশটিতে আগামী বছর একীভূতকরণ বাড়তে পারে। আটলান্টিকের অন্য প্রান্তে ইউরোপও প্রস্তুত। হাইডার জমাবয় জানান, বেশকিছু বড় চুক্তি এখন আলোচনার টেবিলে রয়েছে, যা বছরের প্রথমার্ধে ঘোষিত হবে।