ওয়াশিংটন-বেইজিং বাণিজ্য যুদ্ধ নতুন কোনো ঘটনা নয়। ডোনাল্ড ট্রাম্পের ক্ষমতাগ্রহণ সে ধারাবাহিক পদক্ষেপে বড় আকারের সম্প্রসারণ ঘটাচ্ছে শুধু। বাণিজ্যযুদ্ধের ক্ষতি সামাল দিতে সাম্প্রতিক বছরে মূল ভূখণ্ডের বাইরে বিনিয়োগ বাড়াচ্ছে চীনা কোম্পানিগুলো। শুধু গত মাসেই ভিয়েতনামে প্রায় এক-তৃতীয়াংশ নতুন প্রকল্পে অর্থায়ন করছে তারা। এ পরিবর্তন সম্ভবত দেশটিকে আরো ঝুঁকির মধ্যে ফেলবে। অবশ্য ঝুঁকির কারণ শুধু চীনই নয়, সেসব দেশ ট্রাম্পের বর্ধিত শুল্কের লক্ষ্যবস্তু হচ্ছে, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে যাদের বড় বাণিজ্য উদ্বৃত্ত রয়েছে। ভিয়েতনাম সেসব দেশের একটি। খবর এফটি।
[IMG]http://forex-bangla.com/customavatars/435824399.jpg[/IMG]
বিশ্বের দুই বৃহত্তম অর্থনীতির মধ্যে চলমান বাণিজ্য উত্তেজনার অন্যতম বড় সুবিধাভোগী ভিয়েতনাম। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে দেশটির বাণিজ্য উদ্বৃত্ত গত বছর রেকর্ড ১২ হাজার ৩৫০ কোটি ডলারে পৌঁছেছে, যা চীন ও মেক্সিকোর পর তৃতীয় বৃহত্তম। সরবরাহ চেইন ঝুঁকি হ্রাস ও শুল্ক এড়ানোর উদ্দেশ্যে সাম্প্রতিক বছরে অ্যাপল ও ইন্টেলের মতো কোম্পানি চীন থেকে ভিয়েতনামে উৎপাদন স্থানান্তর করেছে। একই সঙ্গে ক্রমবর্ধমান হারে ভিয়েতনামে বিনিয়োগ করছে চীনা কোম্পানিগুলো। গত বছর দেশটিতে নতুন প্রকল্পের ২৮ শতাংশ ছিল চীনের, যা ২০২৩ সালের তুলনায় ২২ শতাংশ বেশি। বিনিয়োগ বিষয়ে পরামর্শক সংস্থা সানওয়া কিরিন কনসালটিং ভিয়েতনামের প্রধান নির্বাহী মেয়ার টেলবালদে বলেন, ‘চীনা মূলধন বাধ্য হয়ে ভিয়েতনামে আসছে, যদিও এটি এখন আগের মতো সাশ্রয়ী নয়।’
তিনি এও জানান, অনেক চীনা কোম্পানি যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের ক্রেতাদের চাপে নিজ দেশ থেকে স্থানান্তর হতে বাধ্য হচ্ছে। আবার ভিয়েতনামের সরবরাহ চেইন ব্যাপকভাবে চীনের ওপর নির্ভরশীল। অন্তত অর্ধেক কাঁচামাল দেশটি থেকে আসে।
চলতি বছরের জানুয়ারিতে ভিয়েতনামে চীনা বিনিয়োগের বাড়বাড়ন্ত দেখা গেছে। সরকারি তথ্যানুযায়ী, নতুন ৩০ শতাংশ প্রকল্পে বিনিয়োগ করেছে চীনা কোম্পানিগুলো।
চলমান পরিস্থিতিতে ভিয়েতনামে চীনা বিনিয়োগ বৃদ্ধি ও দেশটির কাঁচামালের ওপর নির্ভরতা মার্কিন নজরদারি বাড়াতে পারে। বেইজিং তৃতীয় দেশের মাধ্যমে শুল্ক এড়ানোর চেষ্টা করছে বলে আগেই অভিযোগ এনেছে ট্রাম্প প্রশাসন। এ পরিপ্রেক্ষিতে ট্রাম্প ঘোষিত রেসিপ্রোক্যাল ট্যারিফ বা পারস্পরিক শুল্কের মুখোমুখি হতে পারে ভিয়েতনাম।
এরই মধ্যে ইস্পাত আমদানির ওপর ২৫ শতাংশ শুল্ক আরোপের হুমকি দিয়েছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। এ পদক্ষেপ ভিয়েতনামের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। কারণ যুক্তরাষ্ট্রের পঞ্চম বৃহত্তম স্টিল সরবরাহকারী এশিয়ার এ দেশ।
ভিয়েতনামের রফতানির প্রায় ৩০ শতাংশের বাজার যুক্তরাষ্ট্র। বিশ্লেষকরা বলছেন, উচ্চ শুল্ক ভিয়েতনামের অর্থনীতিতে বড় ধরনের প্রভাব ফেলবে। এটি বিনিয়োগ নিরুৎসাহিত করবে ও বিশ্বের অন্যতম দ্রুত বর্ধনশীল অর্থনীতির প্রবৃদ্ধি কমিয়ে দেবে। বিনিয়োগ বিষয়ে পরামর্শক ইনকর্প ভিয়েতনামের প্রধান নির্বাহী জ্যাক নগুয়েন বলেন, ‘মার্কিন শুল্ক এড়ানোর উপায় হিসাবে ভিয়েতনামকে ব্যবহার করছে চীন— এভাবে বিবেচনা করলে ভিয়েতনামের রফতানি পণ্যে নজরদারি বাড়াতে পারে যুক্তরাষ্ট্র।’
চীনা বিনিয়োগের বেশির ভাগই নিম্ন-মধ্যমমানের উৎপাদন খাতে কেন্দ্রীভূত। এর মধ্যে রয়েছে গাড়ি থেকে শুরু করে সৌর প্যানেলের মতো পণ্য। এদিকে কিছু চীনা পণ্য কোনো ধরনের মূল্য সংযোজন ছাড়াই ‘মেড ইন ভিয়েতনাম’ নামে পুনরায় লেবেল করা হয়। এ ধরনের পণ্য রফতানি যুক্তরাষ্ট্রে অবৈধ। হ্যানয় এরই মধ্যে চীনা পণ্য ও বিনিয়োগের ওপর কড়া নজরদারি শুরু করেছে বলে জানান জ্যাক নগুয়েন। তিনি বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্রের ক্রোধের ঝুঁকি নিয়ে চীনের ট্রান্সশিপমেন্ট হাব হিসেবে নিজেদের ব্যবহার করতে দেবে না ভিয়েতনাম।’ গত মাসে দাভোসে অনুষ্ঠিত ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের সম্মেলনে ভিয়েতনামের প্রধানমন্ত্রী ফাম মিন চিন জানিয়েছিলেন, বাণিজ্য ভারসাম্য নিয়ন্ত্রণে তার দেশে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সমাধান গ্রহণ করবে।
তিনি আরো জানান, আগামী ১০ বছরে বোয়িং থেকে ৫০-১০০টি উড়োজাহাজ কিনবে ভিয়েতনাম। পাশাপাশি অন্যান্য উচ্চ প্রযুক্তির মার্কিন সরঞ্জাম সংগ্রহ করবে। এছাড়া চলতি মাসে দেশটির বাণিজ্যমন্ত্রী নগুয়েন হং দিয়েন জানান, ভিয়েতনাম যুক্তরাষ্ট্র থেকে কৃষিপণ্য আমদানি বাড়াতে প্রস্তুত ও বাণিজ্য সম্পর্ক বাধাগ্রস্ত করতে কোনো ব্যবস্থা নেবে না।
ধারণা করা হচ্ছে, চীনা পণ্য পুনঃরফতানির ওপর চাপ বাড়াবে ভিয়েতনাম। আরএমআইটি ইউনিভার্সিটির সরবরাহ চেইন বিশেষজ্ঞ হুং নগুয়েন বলেন, ‘হ্যানয় চীনা কোম্পানিকে উচ্চ মূল্য সংযোজন উৎপাদনে বিনিয়োগ করতে চাপ দিতে পারে এবং স্থানীয় সামগ্রী ব্যবহারের নিয়ম কঠোর করতে পারে।’
তিনি বলেন, ‘আমার ধারণা ভিয়েতনাম কিছু চীনা বিনিয়োগ প্রত্যাখ্যান করার জন্য প্রযুক্তিগত বাধা ব্যবহার করবে।’
কিন্তু সিঙ্গাপুরের ইসিয়াস-ইউসুফ ইশাক ইনস্টিটিউটের গবেষক নগুয়েন খাক গিয়াং বলেন, ‘ভিয়েতনামকে চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা করতে হবে। আমি আশা করি না যে দেশটি প্রকাশ্যে চীনা বিনিয়োগের বিরুদ্ধে অবস্থান নেবে।’
বিদেশী বিনিয়োগকারীদের জন্য স্থাপিত অন্যতম ভিয়েতনামী শিল্প অঞ্চল ডিপ সি। এখানকার বিক্রয় ও বিপণন বিভাগের পরিচালক কোয়েন সোয়েনেন্স বলেন, ‘ভিয়েতনামে চীনা ও তাইওয়ানি কোম্পানির বিনিয়োগের ৮০ শতাংশ যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপে রফতানির ওপর নির্ভরশীল। চীনা কোম্পানিগুলো ডিপ সির বিক্রয়ের ৪০ শতাংশের বেশি দখল করে নিয়েছে, যা ২০২০-এর দশকের শুরুর দিকে মাত্র ১৫ শতাংশ ছিল।’