[IMG]http://forex-bangla.com/customavatars/1400913958.jpg[/IMG]
দেশে বেসরকারি খাতের ঋণ প্রবৃদ্ধি বেশ কয়েক বছর ধরেই মন্থর। মুদ্রানীতিতে এ খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধির যে লক্ষ্যমাত্রা ধরা হচ্ছিল, সেটি অধরা থাকছিল। তবে চলতি অর্থবছরে এ মন্থরতা তীব্র হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রথম আট মাসে (জুলাই থেকে ফেব্রুয়ারি) দেশের বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহ বেড়েছে মাত্র ২ দশমিক ৬৩ শতাংশ। গত অর্থবছরের একই সময়ে প্রবৃদ্ধির হার ছিল ৫ দশমিক ৫৩ শতাংশ। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা যায়, ২০২৪ সালের জুনের শেষে বেসরকারি খাতে ব্যাংক ঋণের স্থিতি ছিল ১৬ লাখ ৪১ হাজার ২২৯ কোটি টাকা। চলতি বছরের ফেব্রুয়ারির শেষে ঋণের এ স্থিতি বেড়ে ১৬ লাখ ৮৪ হাজার ৩৮৪ কোটি টাকায় উন্নীত হয়েছে। সে হিসাবে আট মাসে বেসরকারি খাতে ঋণ স্থিতি বেড়েছে মাত্র ৪৩ হাজার ১৫৫ কোটি টাকা। আর ঋণ প্রবৃদ্ধির হার ২ দশমিক ৬৩ শতাংশ।
শুধু আট মাসের হিসাবে নয়, বরং ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত এক বছরের পরিসংখ্যানেও বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহ কমে আসার চিত্র দেখা যাচ্ছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে ২০২৫ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত এক বছরে বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধি হয়েছে মাত্র ৬ দশমিক ৮২ শতাংশ, যা গত ২১ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন। চলতি অর্থবছরের জন্য ঘোষিত মুদ্রানীতিতে বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য ৯ দশমিক ৮ শতাংশ ধরা হয়েছে। সে হিসাবে লক্ষ্যের চেয়ে ঋণ প্রবৃদ্ধির হার অনেক কম।
অর্থনীতিবিদ ও ব্যাংক নির্বাহীরা বলছেন, বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধির যে চিত্র দেখা যাচ্ছে, সেটিও নতুন ঋণ নয়। বরং অনাদায়ী সুদ ও সুদহার বৃদ্ধির প্রভাবে স্থিতি বাড়ছে। এক্ষেত্রে নতুন ঋণের পরিমাণ খুবই কম। কিছু ব্যাংকের ঋণ স্থিতি না বেড়ে উল্টো কমছে। বেসরকারি খাতের ঋণপ্রবাহে এতটা খরা এর আগে দেখা যায়নি। যদিও দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও কর্মসংস্থানের প্রধান উৎস হলো বেসরকারি খাত। পণ্য উৎপাদন, বিপণন কিংবা সেবা খাতের বড় অংশ বেসরকারি উদ্যোগনির্ভর। বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ ও ঋণপ্রবাহ বাড়ানো সম্ভব না হলে দেশের অর্থনীতিতে গতি আসবে না।
বেসরকারি খাতের ঋণ প্রবৃদ্ধি এতটা কমে যাওয়া অর্থনীতির জন্য ভালো সংবাদ নয় বলে মনে করেন অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক ড. সেলিম রায়হান। তিনি বলেন, ‘মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্যে কেন্দ্রীয় ব্যাংক সুদহার বাড়িয়েছে। যদিও সুদহার বৃদ্ধির কার্যকর প্রভাব মূল্যস্ফীতিতে দেখা যাচ্ছে না। ঋণের সুদহার বেড়ে যাওয়ার সরাসরি প্রভাবে ব্যবসায়িক খরচ বাড়ছে। এক্ষেত্রে এসএমই খাত সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। উচ্চ সুদহার ব্যবসার নগদপ্রবাহের ওপর চাপ সৃষ্টি করছে। সুদহার আরো বাড়লে ব্যবসা পরিচালনার খরচ বাড়াবে, যা ব্যবসাকে আরো কঠিন করে তুলবে।’
বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম) এ নির্বাহী পরিচালক বলেন, ‘সুদহার ক্রমান্বয়ে বাড়ানোর ফলে ঋণগ্রহণের প্রবণতা কমে যাচ্ছে। এটি বিনিয়োগের ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলছে। ব্যবসায়ীরা যদি উচ্চ সুদের ঋণ পরিশোধ করতে না পারেন, তাহলে খেলাপি ঋণ আরো বাড়বে। পাশাপাশি নতুন প্রকল্প বা ব্যবসা সম্প্রসারণের পথও সংকুচিত হয়ে আসবে। এতে অর্থনীতির প্রবৃদ্ধির গতি আরো শ্লথ হবে, যা কর্মসংস্থানের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে।’
উচ্চ মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের কথা বলে ২০২৩-২৪ অর্থবছরের শুরুতে সংকোচনমুখী মুদ্রানীতি ঘোষণা করে বাংলাদেশ ব্যাংক। ওই সময় ব্যাংক ঋণের সুদহার বাড়ানোর উদ্যোগ নেয়া হয়। এ প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে বাড়ানো হয় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নীতি সুদহার (রেপো রেট)। এর পর থেকে ক্রমাগতভাবে ব্যাংক ঋণের সুদহার বাড়ছে। নীতি সুদহার ৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ১০ শতাংশে উন্নীত করা হয়। চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের জন্য ঘোষিত মুদ্রানীতিতেও সংকোচনমুখী নীতি অব্যাহত আছে। এক্ষেত্রে বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে ৯ দশমিক ৮ শতাংশ।
নগদ টাকার (তারল্য) সংকট ও নীতি সুদহার বাড়ানোর প্রভাবে ২০২৩ সালের জুন থেকে ব্যাংক ঋণের সুদহার বাড়ছে। ঋণের সুদহার সর্বোচ্চ ৯ থেকে বেড়ে এখন প্রায় ১৬ শতাংশে ঠেকেছে। যদিও সুদহার বৃদ্ধির কোনো সুফল জনগণ পাচ্ছে না। বরং বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধি যখন সর্বনিম্ন, তখন মূল্যস্ফীতির হার আরো উসকে উঠতে দেখা গেছে। ২০২৪ সালের জুনে মূল্যস্ফীতির গড় হার ছিল ৯ দশমিক ৭২ শতাংশ। জুলাইয়ে এ হার বেড়ে ১১ দশমিক ৬৬ শতাংশে ঠেকে। এরপর থেকে এখন পর্যন্ত মূল্যস্ফীতির হার ৯ শতাংশের নিচে নামেনি। সর্বশেষ মার্চেও মূল্যস্ফীতির হার ছিল ৯ দশমিক ৩৫ শতাংশ।
মূল্যস্ফীতি না কমলেও সুদহার বৃদ্ধির সুফল বেশ ভালোভাবে কাজে লাগিয়েছে কিছু ব্যাংক। উচ্চ সুদের সরকারি ট্রেজারি বিল-বন্ড ক্রয় ও ঋণগ্রহীতাদের কাছ থেকে বেশি সুদ আদায় করে ২০২৪ সালে ভালো ব্যাংকগুলো রেকর্ড পরিমাণ পরিচালন ও নিট মুনাফা করেছে। প্রথম সারির কয়েকটি ব্যাংকের আর্থিক প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে দেখা যায়, গত বছর ওই ব্যাংকগুলোর আয়ের বড় অংশ এসেছে সরকারি ট্রেজারি বিল-বন্ড থেকে। গত বছরজুড়ে বিল-বন্ডের সুদহার ছিল ১১ থেকে ১৩ শতাংশ। উচ্চ সুদে সরকারকে নিরাপদ ঋণ দেয়ার সুযোগ পাওয়ায় ব্যাংকগুলো বেসরকারি খাত থেকে নিজেদের গুটিয়ে নিয়েছে। আবার রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ফিরে না আসা এবং বিনিয়োগের পরিবেশে উন্নতি না হওয়ায় উদ্যোক্তারাও ঋণ নিতে আগ্রহী হচ্ছেন না বলে ব্যাংক নির্বাহীরা জানিয়েছেন।
এ বিষয়ে মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ মাহবুবুর রহমান বলেন, ‘রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা ও আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্থিতিশীল না হলে কোনো ব্যবসায়ীই নতুন বিনিয়োগে আগ্রহী হন না। সবাই নিজেদের বিদ্যমান ব্যবসা সামলে রাখায় বেশি মনোযোগী হন। এ কারণে বেসরকারি খাতের ঋণ প্রবৃদ্ধি এতটা কমে গেছে। তবে তারল্য সংকট থাকলেও ব্যাংকগুলো এখনো ভালো প্রকল্প পেলে ঋণ দিচ্ছে।’